রাস উৎসবে মুখর এক রাত
উৎসবের প্রস্তুতি শুরু হয়েছিল প্রায় এক মাস আগে। এরপর আসে কাঙ্ক্ষিত সেই দিন। সন্ধ্যা নামতেই শুরু হয় নানা আনুষ্ঠানিকতা। অনুষ্ঠানমঞ্চে আয়োজিত আলোচনা সভায় একে একে বক্তব্য দেন অতিথিরা। সংবর্ধিত করা হয় গুণীজনদের। এরপর মাঝরাতে শুরু হয় মূল আয়োজন। রাতভর শ্রীকৃষ্ণের মহারাসলীলা পরিবেশনের মাধ্যমে দর্শকদের বিমোহিত করে রাখেন শিল্পীরা। পুবের আকাশে যখন উঁকি দেয় সূর্যের আলো, তখন শেষ হয় উৎসবের।
মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জে গত মঙ্গলবার রাতে অনুষ্ঠিত হয় মণিপুরি সম্প্রদায়ের প্রধান ধর্মীয় উৎসব শ্রীকৃষ্ণের মহারাসলীলা। এ উপলক্ষে মাধবপুর ও আদমপুরে বসেছিল রকমারি আয়োজনে বিশাল মেলা। জাতিধর্মবর্ণ–নির্বিশেষে হাজার হাজার ভক্ত এবং দেশি-বিদেশি পর্যটকের ভিড়ে মুখর হয়ে ওঠে কমলগঞ্জের মণিপুরি অঞ্চলগুলো। ভিড় সামলাতে পুলিশ সদস্যদের হিমশিম খেতে হয়।
কার্তিকের পূর্ণিমাতিথিতে গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মাবলম্বী মণিপুরিদের প্রধান ধর্মীয় মহোৎসব শ্রীকৃষ্ণের মহারাসলীলার আয়োজন করা হয়। কমলগঞ্জের মাধবপুর জোড়া মণ্ডপ প্রাঙ্গণে মণিপুরি মহারাসলীলা সেবাসংঘের উদ্যোগে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি সম্প্রদায়ের ১৭৭তম মহারাসলীলা উৎসবের আয়োজন করা হয়। মঙ্গলবার রাত সাড়ে আটটায় অনুষ্ঠিত হয় আলোচনা সভা, গুণীজন সংবর্ধনা। সেখানে রাস উৎসব উপলক্ষে প্রকাশিত স্মারক সংকলনের মোড়ক উন্মোচনও করা হয়।
মণিপুরি মহারাসলীলা সেবাসংঘের সভাপতি যোগেশ্বর সিংহের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন মৌলভীবাজারের জেলা প্রশাসক নাজিয়া শিরীন। সংঘের সাধারণ সম্পাদক শ্যাম সিংহের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন মৌলভীবাজারের পুলিশ সুপার ফারুক আহমেদ, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মল্লিকা দে, কমলগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আশেকুল হক, জুড়ী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা অসীম চন্দ্র বণিক, জ্যেষ্ঠ সহকারী পুলিশ সুপার (শ্রীমঙ্গল সার্কেল) আশরাফুজ্জামান, কমলগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আরিফুর রহমান, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড সিলেটের নির্বাহী প্রকৌশলী প্রবীর কুমার দে, রাজশাহী আর্ট কলেজের প্রভাষক চিত্রশিল্পী নারগিস পারভীন, মণিপুরি সমাজকল্যাণ সমিতির সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা আনন্দ মোহন সিংহ। এরপর রাত ১২টা থেকে বুধবার ভোর পর্যন্ত চলে শ্রীকৃষ্ণের মহারাসলীলা।
অপরদিকে রাসোৎসব-২০১৯ উদ্যাপন পরিষদের উদ্যোগে আদমপুর মণিপুরি কালচারাল কমপ্লেক্স প্রাঙ্গণে মীতৈ মণিপুরি সম্প্রদায়ের ৩৪তম রাস উৎসব ও আদমপুর তেতইগাঁও মধুমঙ্গল শর্মা মণ্ডপ প্রাঙ্গণে মণিপুরি সাংস্কৃতিক পরিষদের আয়োজনে চতুর্থ বারের মতো রাস উৎসব আয়োজন করা হয়। এখানে রাত আটটায় আলোচনা সভা ও ভারতের মণিপুর থেকে আগত অতিথিদের সংবর্ধনা দেওয়া হয়। রাত ১১টা থেকে বুধবার ভোর পর্যন্ত চলে মহারাসলীলা উৎসব। ভোরের সূর্যোদয়ের পর অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ঘটে।
১৭৭৯ সালে মণিপুরের মহারাজা ভাগ্যচন্দ্র স্বপ্নদৃষ্ট হয়ে যে নৃত্যগীতের প্রবর্তন করেছিলেন, তা–ই রাস উৎসব। ভাগ্যচন্দ্রের পরবর্তী রাজাদের বেশির ভাগই ছিলেন নৃত্যগীতে পারদর্শী এবং তাঁরা নিজেরাও রাসনৃত্যে অংশ নিতেন। সেই ধারাবাহিকতায় কমলগঞ্জে উদ্যাপিত হয়ে আসছে রাস উৎসব। তুমুল হইচই, ঢাকঢোল, মৃদঙ্গ, করতাল ও শঙ্খধ্বনির মধ্য দিয়ে রাধাকৃষ্ণের লীলাকে ঘিরেই এই দিনটি ভিন্ন আমেজ নিয়ে আসে কমলগঞ্জ উপজেলাবাসীর জীবনে। মণিপুরি নৃত্য শুধু কমলগঞ্জের নয়, গোটা ভারতীয় উপমহাদেশের তথা সমগ্র বিশ্বের নৃত্যকলায় একটি বিশেষ স্থান দখল করে নিয়েছে।
১৯২৬ সালে সিলেটের মাছিমপুরে মণিপুরি মেয়েদের পরিবেশিত রাসনৃত্য উপভোগ করে মুগ্ধ হয়েছিলেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। পরে কবিগুরু কমলগঞ্জের নৃত্যশিক্ষক নীলেশ্বর মুখার্জীকে শান্তিনিকেতনে নিয়ে প্রবর্তন করেছিলেন মণিপুরি নৃত্যশিক্ষা।