রাতেও সেন্ট মার্টিনে পর্যটকের ভিড়, সংক্রমণের আশঙ্কা
৬ জানুয়ারি বুধবার, রাত আটটা। সেন্ট মার্টিন দ্বীপের পশ্চিম সৈকতের একটি দোকানের সামনে ২০-২৫ জন পর্যটকের জটলা। খোলা দোকানটির টেবিলে সাজানো কোরাল, লবস্টার, রুপচাঁদা, টেকচান্দা, ফ্লাইংফিশ, লাক্ষ্যা, কাঁকড়াসহ নানা প্রজাতির সামুদ্রিক মাছ। ভ্রমণে আসা পর্যটকেরা দামদর ঠিক করে সেসব মাছ খাচ্ছেন। করোনা সংক্রমণের আশঙ্কা উপেক্ষা করে আলোঝলমলে এমন পরিবেশ থাকে গভীর রাত পর্যন্ত।
এদিকে করোনা পরিস্থিতির কারণে ২ জানুয়ারি পরিবেশ অধিদপ্তর গণবিজ্ঞপ্তি জারি করে সেন্ট মার্টিন দ্বীপের সৈকতে আলো জ্বালিয়ে বারবিকিউ, দোকানপাটে কেনাবেচা, সৈকতের পাথরে ওঠা, মোটরসাইকেল, সাইকেলসহ যেকোনো ধরনের যানবাহনে চলাচল নিষিদ্ধসহ ১৪টি বিধিনিষেধ আরোপ করেছে। কিন্তু বাস্তবে উল্টো চিত্র। সেন্ট মার্টিন চলছে আগের মতোই। গণবিজ্ঞপ্তি কার্যকর কিংবা তদারক করার কেউ নেই।
সেখানকার দোকানদার নুরুল ইসলাম বলেন, পাঁচ বছর ধরে এই সৈকতে তিনি বারবিকিউ করছেন। সামুদ্রের তাজা রুপচাঁদা, টেকচান্দা, ফ্লাইংফিশ, কোরাল, কাঁকড়া, লবস্টার ভেজে পর্যটকদের কাছে বিক্রি করছেন। কেউ নিষেধ করেনি।
রাতের সৈকতে বারবিকিউ নিষেধের বিষয়ে জানতে চাইলে নুরুল ইসলাম উল্টো প্রশ্ন ছোড়েন, গণবিজ্ঞপ্তি কখন জারি করল? তারপর বললেন, সৈকতের কোনো ব্যবসায়ীর তা জানা নেই। জানা থাকলেও কেউ তা মানবে না। কারণ, পর্যটকদের কাছে মাছ বিক্রি না হলে স্থানীয় পাঁচ শতাধিক জেলে ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীর পরিবার পথে বসবে।
নুরুল ইসলামের দোকানের পাশেই কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমদের বাংলোবাড়ি ‘সমুদ্রবিলাস’। সমুদ্রবিলাসের সামনেও বারবিকিউর কয়েকটি দোকান। তাতেও আলো জ্বালিয়ে চলছে ভাজা মাছ বিক্রি। ক্রেতারা সবাই পর্যটক। শিশু থেকে ষাটোর্ধ্ব বৃদ্ধরাও আছেন। অধিকাংশের মুখে নেই মাস্ক। করোনা সংক্রমণ বিষয়ে কারও ভ্রুক্ষেপই নেই।
ঢাকা থেকে দ্বীপ ভ্রমণে এসেছেন ব্যবসায়ী আমিনুর রহমান। সঙ্গে তাঁর বৃদ্ধ বাবা, স্ত্রী, তিন ছেলেমেয়ে। রাত ১০টার দিকে সৈকতের উত্তর পাশের একটি দোকানে বসে টেকচান্দা ও লবস্টার গ্রিল খাচ্ছিলেন তাঁরা। তাঁদের পাশে আরও ১২-১৫ জন পর্যটক কাঁকড়া, ফ্লাইংফিশ, কোরাল গ্রিল খাচ্ছেন। প্রতিটির দাম আকারভেদে ১৫০ থেকে ২ হাজার টাকা। লবস্টার ও কোরালের দাম সবচেয়ে বেশি। আমিনুর রহমান বলেন, ‘রাতের সেন্ট মার্টিন এতটা জমজমাট হবে কল্পনাও করিনি। দ্বীপের চারদিকে নীল জলের বঙ্গোপসাগর। সমুদ্রের পাশে বসে ঢেউয়ের হুংকার শুনতে শুনতে শীতল হাওয়ায় গরম পরোটার সঙ্গে জলজ্যান্ত লবস্টার কিংবা কোরাল ভেজে খাওয়ার আনন্দই অন্য রকম।’
গণবিজ্ঞপ্তির বিষয়টি স্মরণ করিয়ে দিলে আমিনুর রহমান বলেন, সেন্ট মার্টিনের সৌন্দর্য ধরে রাখতে হলে অবশ্যই গণবিজ্ঞপ্তির দ্রুত কার্যকর দরকার। প্রয়োজন অতিরিক্ত পর্যটকদের চাপ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
রাত ১২টা পর্যন্ত সরেজমিনে দেখা যায়, দ্বীপের পশ্চিম সৈকত থেকে উত্তর পাশে প্রাসাদ প্যারাডাইস পয়েন্ট পর্যন্ত প্রায় তিন কিলোমিটার বালুচরে চেয়ার–টেবিল বসিয়ে অন্তত ২১০টি দোকানে বিক্রি হচ্ছে সামুদ্রিক মাছ, ডাব, শুঁটকি, স্যান্ডেল, জুতা, টুপিসহ বিভিন্ন পোশাক। সব দোকানে জ্বলছে বাহারি সোলার প্যানেলের বাতি। কারণ, এই দ্বীপে বিদ্যুৎ নেই। দোকানগুলোর সামনে ভিড় জমিয়েছেন হাজারো পর্যটক। প্রায় ৯০ শতাংশ পর্যটকের মুখে মাস্ক নেই। সামাজিক দূরত্বও মানা হচ্ছে না।
গণবিজ্ঞপ্তির বিষয়ে সেখানকার লোকজনকে সচেতন করা হচ্ছে। জনবলসংকটের কারণে পরিস্থিতি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না।
দোকানগুলোর মধ্যে অন্তত ৩৫টিতে আলো জ্বালিয়ে চলছে বারবিকিউ পার্টি। মাছ খেতে খেতে লোকজনের হইচই আর নাচ-গান। মুঠোফোনের ফ্লাশলাইট জ্বালিয়ে চলছে ছবি তোলা ও ভিডিও ধারণ। গভীর রাত পর্যন্ত পর্যটকের ভিড়ে করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি আরও বাড়ে।
ছেলেমেয়ে নিয়ে ভ্রমণে এসেছেন চট্টগ্রাম মহানগরের ব্যাংক কর্মকর্তা হারুনুর রশিদ। বলেন, ‘করোনাভাইরাসের কারণে ছেলেমেয়েদের স্কুল-কলেজ দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ আছে। শহরে তেমন কোথাও বের হওয়ার পরিবেশ ও পরিস্থিতি নেই। নির্জন দ্বীপ বিবেচনা করেই ছেলেমেয়েদের নিয়ে সেন্ট মার্টিন ভ্রমণে আসা। এসে দেখি মানুষের ঢল।’
সৈকতের শুঁটকি বিক্রেতা নবী হোসেন ও ডাব বিক্রেতা উলা মিয়া জানান, পর্যটন মৌসুমের পাঁচ মাস (নভেম্বর-মার্চ) সেন্ট মার্টিনে পর্যটকেরা আসেন। এ সময় দ্বীপে উৎপাদিত মাছ, শুঁটকি বিক্রি হয়। ডাব বিক্রি করে স্থানীয় জেলে ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা জীবিকা নির্বাহ করেন। গণবিজ্ঞপ্তি জারিতে এসব ব্যবসা বন্ধ হলে অসহায় পরিবারগুলো পথে বসবে।
বুধবার টেকনাফ থেকে সাতটি প্রমোদতরি জাহাজ, ১২টির বেশি কাঠের ট্রলার ও ৫০টির বেশি স্পিডবোটে সেন্ট মার্টিন ভ্রমণে এসেছেন অন্তত সাড়ে তিন হাজার পর্যটক। তাঁদের মধ্যে অন্তত আড়াই হাজার সেন্ট মার্টিনে রাতযাপন করছেন। রাতের সেন্ট মার্টিন উপভোগ করতে হাজারো পর্যটক নেমে পড়েন সৈকতে। সমুদ্রের গর্জন আর নীল জলের অপরূপ দৃশ্য মানুষের মন-প্রাণ সতেজ করলেও দ্বীপটির যন্ত্রণা কারও অনুভূতিতে বাজছে না। করোনা সংক্রমণের তোয়াক্কাও কেউ করছে না।
গণবিজ্ঞপ্তি কিংবা বিধিনিষেধ লঙ্ঘন করলে শাস্তির বিধান আছে। কিন্তু তা কার্যকরে কেউ নেই। গণবিজ্ঞপ্তি কার্যকরের বিষয়ে আজ বৃহস্পতিবার পর্যন্ত সেখানকার কোস্টগার্ড, পুলিশ ও ইউনিয়ন পরিষদ কিছুই জানে না।
পরিবেশ অধিদপ্তর কক্সবাজার কার্যালয়ের উপপরিচালক শেখ নাজমুল হক বলেন, গণবিজ্ঞপ্তির বিষয়ে সেখানকার লোকজনকে সচেতন করা হচ্ছে। জনবলসংকটের কারণে পরিস্থিতি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না।