রাতারগুলের ওয়াচটাওয়ার নড়বড়ে, ওঠানামা বন্ধ
সিলেটের জলাবন রাতারগুলের সেই ‘ওয়াচটাওয়ার’ পাঁচ বছরের মাথায় নড়বড়ে হয়ে পড়েছে। একসঙ্গে একাধিক পর্যটক ওয়াচটাওয়ারে উঠলে সেটি কাঁপছে। এ অবস্থায় যেকোনো সময় ওয়াচটাওয়ার ভেঙে পড়তে পারে, এমন আশঙ্কায় টাওয়ারে ওঠানামা না করতে সপ্তাহখানেক আগে বন বিভাগ নির্দেশিকা সাঁটিয়েছিল। কিন্তু তা না মানায় আজ রোববার থেকে টাওয়ারে ওঠার মুখে বেড়া দিয়ে ওঠানামা পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
জলাবনের পর্যবেক্ষণের দায়িত্বে থাকা বন বিভাগ সিলেটের উত্তর রেঞ্জার সাদ উদ্দিন প্রথম আলোকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, করোনা পরিস্থিতির কারণে একটানা প্রায় ছয় মাস রাতারগুলে পর্যটকদের যাতায়াত বন্ধ ছিল। ওই সময় ওয়াচটাওয়ারটির নড়বড়ে অবস্থা পরিলক্ষিত হয়। সম্প্রতি পর্যটকদের যাতায়াত শুরু হলে ওয়াচটাওয়ারে ওঠানামার ক্ষেত্রে সতর্কতার একটি নির্দেশিকা সেখানে সাঁটানো হয়। কিন্তু এ নির্দেশনা না মেনে একসঙ্গে একাধিক পর্যটক সেখানে ওঠানামা করায় দুর্ঘটনার আশঙ্কা থেকে পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলার ফতেপুর ইউনিয়নে অবস্থিত রাতারগুল জলার বন (সোয়াম্প ফরেস্ট) হওয়ায় ১৯৭৩ সালে সংরক্ষিত ঘোষণা করে বন বিভাগ। নদী ও হাওরবেষ্টিত ৫০৪ দশমিক ৫০ একর আয়তনের পুরো এলাকা প্রকৃতিপ্রেমীদের কাছে অনেকটা অজানা ছিল। ২০১২ সালের বিশ্ব পর্যটন দিবসে প্রথম আলোর প্রথম পাতায় রাতারগুলের একটি আলোকচিত্র নতুন করে পরিচিত করে তোলে রাতারগুলকে।
‘রাতারগুল বন্য প্রাণী অভয়ারণ্য স্থাপন ও উন্নয়ন’ নামে বন বিভাগের একটি প্রকল্প প্রস্তাবের তথ্যে উল্লেখ রয়েছে, রাতারগুল বাংলাদেশের একমাত্র সমৃদ্ধ জলার বন। প্রাকৃতিকভাবে বেড়ে ওঠা হিজল-করচ-বরুণগাছের পাশাপাশি বেত, ইকরা, খাগড়া, মূর্তা ও শণজাতীয় গাছ রাতারগুলকে জলার বন হিসেবে অনন্য করেছে।
বনে ৭৩ প্রজাতির উদ্ভিদের সঙ্গে ২৫ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী, ২০ প্রজাতির সরীসৃপ, ১৭৫ প্রজাতির পাখি ও ৯ প্রজাতির উভচর প্রাণীর অস্তিত্ব রয়েছে। এই জীববৈচিত্র্য রক্ষায় জাতীয় উদ্যান পরিকল্পনার আওতায় ওয়াচটাওয়ার নির্মাণসহ কিছু অবকাঠামোগত উন্নয়ন হয়।
বন বিভাগ সূত্র জানায়, জাতীয় উদ্যান পরিকল্পনায় রাতারগুলে ওয়াচটাওয়ারটি নির্মাণ করা হয়েছিল ২০১৪ সালের এপ্রিলে। টাওয়ারটি নির্মাণকালে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনসহ (বাপা) সিলেটের পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো আপত্তি জানায়। বনের মধ্যবর্তী স্থান রাঙাকুড়ি এলাকায় ৫০ ফুট উঁচু (পাঁচতলা) এই টাওয়ারটি নির্মাণকালে বন বিভাগের যুক্তি ছিল, বনকে পর্যবেক্ষণে রাখা। এক পাশে বন বিভাগের বিট কর্মকর্তার কার্যালয়েও পাকা দোতলা ভবন ‘বিশ্রামাগার’ হিসেবে নির্মাণ করা হয়। টাওয়ার-বিশ্রামাগারে যেতে বনের ভেতর ১৫ ফুট চওড়া এক কিলোমিটার দীর্ঘ রাস্তাও নির্মাণ পরিকল্পনার মধ্যে ছিল। এসব অবকাঠামো নির্মাণে ব্যয় নির্ধারণ ছিল প্রায় ৬ কোটি টাকা। টাওয়ার নির্মাণে ব্যয় হয় প্রায় ৯২ লাখ টাকা।
সংরক্ষিত বনের ভেতর এ ধরনের স্থাপনা নির্মাণ করা হলে বন ক্ষতিগ্রস্ত হবে—এমন আশঙ্কা পরিবেশবাদীদের মধ্য থেকে প্রকাশ পেলে ২০১৪ সালের ১০ এপ্রিল প্রথম আলোয় ‘রাতারগুল কতল হবে?’ শিরোনামে একটি সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশ হয়। এরপর রাতারগুল এলাকা থেকেও ওয়াচটাওয়ার নির্মাণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জোরালো হয়।
‘বনকে বনের মতো থাকতে দাও’ স্লোগান সামনে রেখে ২০১৪ সালের ২২ এপ্রিল সিলেট বিভাগীয় বন কর্মকর্তার কার্যালয়ের সামনে ‘ভূমিসন্তান বাংলাদেশ’ নামের একটি সংগঠন পরিবেশবাদীদের নিয়ে অবস্থান কর্মসূচি পালন করে। তখন ওয়াচটাওয়ারের নির্মাণকাজ বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত জানানো হয়েছিল। ছয় মাস পর দ্রুত নির্মাণকাজ শেষ করে টাওয়ারটি ২০১৫ সালের বর্ষা মৌসুমে উন্মুক্ত করা হয়।
রাতারগুল কতল হবে?পরিবেশবাদী সংগঠন ‘ভূমিসন্তান বাংলাদেশ’-এর সমন্বয়ক মোহাম্মদ আশরাফুল কবীর বলেন, ‘বনকে বনের মতো থাকতে দেওয়ার আহ্বান ছিল আমাদের। এ জন্য ওয়াচটাওয়ার স্থাপনের প্রতিবাদ করেছিলাম আমরা। একই সময়ে হাকালুকি হাওর, টাঙ্গুয়ার হাওরে ওয়াচটাওয়ার নির্মাণ করা হয়। সেগুলো ঠিক আছে। শুধু রাতারগুলের টাওয়ার পাঁচ বছরে নড়বড়ে হলো কেন—এ বিষয়টি দেখা দরকার।’
এ ব্যাপারে বন বিভাগ সিলেটের উত্তর রেঞ্জার সাদ উদ্দিন জানিয়েছেন, জাতীয় উদ্যান পরিকল্পনায় ওয়াচটাওয়ার নির্মাণ করা হয়েছিল। এ বিষয়টি লিখিতভাবে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। তারা পর্যবেক্ষণ করে পরবর্তী ব্যবস্থা নেবে। এর আগে ওয়াচটাওয়ারে যাতায়াত বন্ধ রাখা হবে।