রাতারগুল থেকে প্লাস্টিক বর্জ্য অপসারণ
বর্ষাকালই যেন সিলেটের জলাবন রাতারগুলের যৌবন। বর্ষা আসার আগে রাতারগুল বনের ভেতরকার অবস্থা কেমন, তা দেখতে গিয়ে পাওয়া গেল বনভূমিজুড়ে ছড়ানো-ছিটানো প্লাস্টিক বর্জ্য। পর্যটকদের যত্রতত্র ফেলে রাখা এই বর্জ্য বর্ষাকালে ছড়িয়ে পড়বে আশপাশের এলাকায়। তখন ফসলি জমিরও ক্ষতি হবে। এই আশঙ্কা থেকে গোয়াইনঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) তাহমিলুর রহমান সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম আহ্বান জানিয়ে একদল বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী ও স্বেচ্ছাসেবীকে নিয়ে প্লাস্টিক বর্জ্য পরিষ্কার করেছেন।
আজ শনিবার আন্তর্জাতিক জীববৈচিত্র্য দিবসে ফেসবুকে একটি আহ্বানের পরিপ্রেক্ষিতে রাতারগুলে দিনভর প্লাস্টিক বর্জ্য পরিচ্ছন্নতার কাজ চলে।
সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলার ফতেপুর ইউনিয়নে অবস্থিত রাতারগুল জলাবন (সোয়াম্প ফরেস্ট) হওয়ায় ১৯৭৩ সালে সংরক্ষিত ঘোষণা করে বন বিভাগ। নদী ও হাওরবেষ্টিত ৫০৪ দশমিক ৫০ একর আয়তনের পুরো এলাকা প্রকৃতিপ্রেমীদের কাছে অনেকটা অজানা ছিল। ২০১২ সালের বিশ্ব পর্যটন দিবসে প্রথম আলোর প্রথম পাতায় রাতারগুলের একটি আলোকচিত্র প্রকাশিত হলে তা নতুন করে পরিচিত করে তোলে এই নয়নাভিরাম স্থানটিকে।
‘রাতারগুল বন্য প্রাণী অভয়ারণ্য স্থাপন ও উন্নয়ন’ নামে বন বিভাগের একটি প্রকল্প প্রস্তাবের তথ্যে উল্লেখ রয়েছে, রাতারগুল দেশের একমাত্র সমৃদ্ধ জলার বন। প্রাকৃতিকভাবে বেড়ে ওঠা হিজল-করচ-বরুণগাছের পাশাপাশি বেত, ইকরা, খাগড়া, মুরতা ও শণজাতীয় গাছ রাতারগুলকে জলাবন হিসেবে অনন্য করেছে। সংরক্ষিত বনে ৭৩ প্রজাতির উদ্ভিদের সঙ্গে ২৫ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী, ২০ প্রজাতির সরীসৃপ, ১৭৫ প্রজাতির পাখি ও ৯ প্রজাতির উভচর প্রাণীর অস্তিত্ব রয়েছে।
পরিচ্ছন্নতায় অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীরা জানিয়েছেন, বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ বন্ধ থাকার অবসরে তাঁরা নিজ নিজ এলাকাতেই ছিলেন। আন্তর্জাতিক জীববৈচিত্র্য দিবসে গোয়াইনঘাট ইউএনওর ফেসবুকে করা আহ্বানে তাঁরা বন্ধুবান্ধব নিয়ে পরিচ্ছন্নতার কাজে যোগ দেন। ৭টি নৌকা নিয়ে তাঁরা ৪৩ জন শিক্ষার্থী এ কাজে অংশ নেন। সকাল নয়টা থেকে বেলা তিনটা পর্যন্ত টানা ছয় ঘণ্টা রাতারগুল বনের ভেতরে হেঁটে হেঁটে বর্জ্য সংগ্রহ করা হয়। পরে বনের নৌপথে নৌকা নিয়ে বর্জ্য অপসারণ করা হয়। প্লাস্টিক বর্জ্যের মধ্যে অধিকাংশ ছিল খালি বোতল, পলিথিন, চকলেট-চিপসের প্যাকেট।
পরিচ্ছন্নতার কাজ শেষে বিকেলে রাতারগুলের চৌমোহনীতে অংশগ্রহণকারী স্বেচ্ছাসেবী ও এলাকাবাসীকে নিয়ে সচেতনতামূলক সভা হয়। এতে ইউএনওসহ পরিচ্ছন্নতার কাজে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীরাও বক্তব্য দেন। টানা ছয় ঘণ্টা রাতারগুলে প্লাস্টিক বর্জ্য অপসারণ করতে গিয়ে তাঁরা অভিজ্ঞতার বর্ণনা ও রাতারগুল পরিচ্ছন্ন রাখতে পরামর্শ তুলে ধরেন।
বনের ভেতর ছাড়াও রাতারগুল প্রবেশের খালে বেশি প্লাস্টিক বর্জ্য পাওয়া গেছে উল্লেখ করে স্বেচ্ছাসেবী শিক্ষার্থীরা বলেছেন, পর্যটকেরা সাধারণত বনের যে অংশগুলোতে নৌকা থেকে নামেন, সেখানে এবং বনের ভেতরেও বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় সতর্কতা রাখা দরকার। বনের মধ্যে পর্যটকেরা ওয়ানটাইম প্লাস্টিকের প্যাকেটে খাবার খেয়ে প্লাস্টিক ফেলে যান। শুষ্ক মৌসুমে বনের ভেতর বিভিন্ন স্থানে আগুন ধরিয়ে রান্না করার আলামত পাওয়া গেছে। জলাবন সবাইকে মুগ্ধ করলে সুরক্ষায় অনেকেই বনের পরিবেশের দিকে খেয়াল রাখেন না। গভীর বনে গিয়ে দেখা যায়, মুরতাগাছসহ বেশ কিছু গাছ কাটা। মূলত মাছ ধরার উদ্দেশ্যে জলাধারের বিভিন্ন স্থানে এ গাছগুলো দিয়ে জাগ দেওয়া হয়েছে। এই বর্ষা শুরুর আগে বনের বিভিন্ন অংশে বাঁধ দিয়ে পানি অপসারণ করে মাছ ধরারও অভিযোগ পাওয়া যায়। বন বিভাগকে এ বিষয়ে তদারকি বৃদ্ধি করার পরামর্শ তাঁদের।
এ ব্যাপারে গোয়াইনঘাটের ইউএনও তাহমিলুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, রাতারগুলে বর্ষকালে বেশি পর্যটকের যাতায়াত বাড়ে। করোনা পরিস্থিতির কারণে পর্যটকদের যাতায়াত সীমিত রয়েছে। বর্ষার আগমুহূর্তে বনের ভেতরকার অবস্থা দেখতে গিয়ে প্লাস্টিক বর্জ্য যত্রতত্র পড়ে রয়েছে দেখা যায়। ২২ মে আন্তর্জাতিক জীববৈচিত্র্য দিবসে ফেসবুকে আহ্বানে তাৎক্ষণিকভাবে এলাকার বাসিন্দা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী ও স্বেচ্ছাসেবীদের নিয়ে বর্জ্য পরিষ্কার করা হয়। পরিচ্ছন্নতার কাজ শেষে তাঁদের অভিজ্ঞতায় যেসব বিষয় ও পরামর্শ ব্যক্ত হয়েছে, উপজেলা পর্যটন উন্নয়ন ও পরিবেশ সংরক্ষণ কমিটির সভায় তা তুলে ধরে পরবর্তী করণীয় নির্ধারণ করা হবে।