যে পথে এসেছিলেন, সে পথেই মিয়ানমারে ফিরতে চান কেফায়েত উল্লাহরা
কক্সবাজার শহর থেকে ৭৬ কিলোমিটার দূরে উখিয়ার জামতলী (ক্যাম্প-১৮) আশ্রয়শিবির। আজ রোববার সকাল থেকে রোহিঙ্গারা প্রস্তুতি নিচ্ছিল মাঠে ‘বাড়ি চলো’ প্রচারণা সমাবেশে যোগ দিতে। কিন্তু বাদ সাধে বৃষ্টি। এর মধ্যে সকাল সাড়ে ১০টার দিকে রাস্তায় বের হন আশ্রয়শিবিরের বাসিন্দা কেফায়েত উল্লাহ (৬০)। সঙ্গে তাঁর দুই ছেলে রহমত উল্লাহ (২৫) ও আজম উল্লাহ (২০)। হাতে একটি প্রচারপত্র, তাতে লেখা, ‘চলো বাড়ি চলো’।
কেফায়েত উল্লাহ বললেন, জামতলী পাহাড়ের আশ্রয়শিবিরে ছোট্ট ত্রিপলের ছাউনিতে কখন যে পাঁচ বছর কেটে গেল, টেরই পাননি। তাঁরা কখন আরাকানে (রাখাইন রাজ্যে) ফিরতে পারবেন, তারও নিশ্চয়তা নেই। তাঁরা দ্রুত মিয়ানমারে ফিরে যেতে চান। বিশ্ববাসীকে এই দাবি জানানোর জন্য ‘বাড়ি চলো’ প্রচারণায় অংশ নিচ্ছেন উল্লেখ করে কেফায়েত উল্লাহ বলেন, ‘আমরা যে পথে বাংলাদেশে এসেছিলাম, সে পথেই ফিরতে চাই মিয়ানমারে।’
কেফায়েত উল্লাহর বাড়ি মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের মংডু শহরের সিকদারপাড়ায়। ২০১৭ সালে ২৫ আগস্টের পর রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর নিপীড়ন-হত্যাযজ্ঞ শুরু হয়। এর চার দিন পর ২৯ আগস্ট রাতে স্ত্রী ও পাঁচ ছেলেমেয়ে নিয়ে নাফ নদী অতিক্রম করে টেকনাফে পালিয়ে আসেন। সেখান থেকে ঠাঁই হয় উখিয়ার এই আশ্রয়শিবিরে।
কেফায়েত উল্লাহর মতো কয়েক হাজার রোহিঙ্গা রোববার জামতলীর সিমকার্ড মাঠ এলাকার সমাবেশে যোগ দেন। সেখানে দ্রুত রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু, ১৯৮২ সালের নাগরিকত্ব আইন বাতিল, রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ফেলে আসা সম্পত্তি ফেরতসহ সাত দফা দাবি ঘোষণা করা হয়।
উখিয়ার লাম্বাশিয়া আশ্রয়শিবিরেও প্রায় ১০ হাজার রোহিঙ্গার পৃথক সমাবেশ হয়েছে। তা ছাড়া উখিয়া ও টেকনাফের ৩৪টি আশ্রয়শিবিরের সব কটিতে ছোট ছোট ৩০টির বেশি সমাবেশ করে জন্মভূমিতে ফিরে যাওয়ার দাবি জানায় রোহিঙ্গারা।
গত পাঁচ বছরে বাংলাদেশ সরকারের উদ্যোগে তিন দফা রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। কিন্তু রোহিঙ্গাদের অনীহার কারণে প্রত্যাবাসন সম্ভব হয়নি। তখন রোহিঙ্গাদের দাবি ছিল, মিয়ানমার সরকার কর্তৃক রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দিতে হবে।
লম্বাশিয়া আশ্রয়শিবিরের সমাবেশে কথা হয় ‘বাড়ি চলো’ প্রচারণা আয়োজকদের একজন মো. ওসমানের (৫৪) সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আমরা এই দেশে আশ্রিত, এটি আমাদের চিরস্থায়ী ঠিকানা নয়। দিন যত বাড়ছে, সমস্যা তত প্রকট হচ্ছে। কিন্তু আমরা এখানে (বাংলাদেশে) থাকতে চাই না। আমরা নিজের অধিকার নিয়ে দ্রুত মিয়ানমারে ফেরত যেতে চাই। তাই ‘‘বাড়ি চলো’’ আন্দোলন।’
আরেক রোহিঙ্গা সাব্বির আহমদ (৫৫) বলেন, বিশ্বসম্প্রদায়ের উচিত রোহিঙ্গাদের পক্ষে আরও জোরালো ভূমিকা রাখা। আগামীকাল ২০ জুন বিশ্ব শরণার্থী দিবস। বিশ্বসম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে এই সমাবেশ।
রোহিঙ্গা নেতা মৌলভি সিরাজুল ইসলাম বলেন, আশ্রয়শিবিরে ১০-১২ লাখ রোহিঙ্গা পাঁচ বছর ধরে পড়ে আছে। বাংলাদেশ সরকার নিরাপত্তা দিচ্ছে, এ জন্য সরকারের কাছে রোহিঙ্গা জাতি কৃতজ্ঞ। জাতিসংঘের প্রতিও কৃতজ্ঞ। কিন্তু এভাবে কত দিন পাহাড়ের আশ্রয়শিবিরে পড়ে থাকবেন তাঁরা? সিরাজুল বলেন, ‘আমরা ফিরতে চাই, কিন্তু মিয়ানমারের জালেম সরকার রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেবে না কিছুতেই। তারা রোহিঙ্গা মুসলমানদের নাগরিক বলেও স্বীকার করছে না।’
কুতুপালং আশ্রয়শিবিরের রোহিঙ্গা নেতা জালাল আহমদ (৬০) বলেন, মিয়ানমার সরকার সীমান্তে ইতিমধ্যে কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে ঘিরে রেখেছে। সীমান্তে পুঁতে রেখেছে নিষিদ্ধ স্থলমাইন। রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গা পল্লি নিশ্চিহ্ন (ধ্বংস) করে সেখানে গড়ে তোলা হয়েছে অর্থনৈতিক অঞ্চল ও সামরিক বাহিনীর ব্যারাক। এখন প্রত্যাবাসন শুরু হলে মিয়ানমার সরকার চাইবে রোহিঙ্গাদের সেখানকার (মংডু) ট্রানজিট ক্যাম্পে রেখে দিতে, কিন্তু রোহিঙ্গা চায় জন্মভিটায় ফিরতে।
বালুখালী ক্যাম্পের রোহিঙ্গা নেতা লাল মিয়া (৫৬) বলেন, প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় যুক্তরাষ্ট্র, জাতিসংঘ, ওআইসি, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, বাংলাদেশ, এনজিওসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে যুক্ত করতে সমাবেশ থেকে দাবি জানানো হয়। রাখাইনে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের যাতায়াতের সুযোগও রাখতে হবে। কিন্তু মিয়ানমার সহজে এসব দাবি মানবে, বিশ্বাস হয় না। তাই মিয়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিক মহলের চাপ আরও বাড়ানোর জন্যই রোহিঙ্গাদের ‘বাড়ি চলো’ কর্মসূচি।
রোহিঙ্গারা বলেন, ২০১৮ সালের দিকে সাধারণ রোহিঙ্গাদের নেতা হিসেবে আবির্ভাব ঘটে মাস্টার মুহিবুল্লাহর। আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি পিস ফর হিউম্যান রাইটস নামের সংগঠন প্রতিষ্ঠা করে সাধারণ রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত নিয়ে যেতে সংগঠিত করেছিলেন তিনি। আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও বেশ জোরালো জনমত গড়ে তুলেছিলেন। সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত হওয়ার ছয় মাস আগে মুহিবুল্লাহ শুরু করেছিলেন ‘গোয়িং হোম’ বা ‘বাড়ি চলো’ কর্মসূচি। কিন্তু প্রত্যাবাসনবিরোধী গোষ্ঠী ২০২১ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর গুলি করে হত্যা করে মুহবুল্লাহকে। মূলত এর পর থেকে রোহিঙ্গারা নেতৃত্বহীন হয়ে পড়ে।