যে কন্যার জন্য গর্ব লক্ষ্মীছড়িবাসীর
খাগড়াছড়ির লক্ষ্মীছড়ি উপজেলা পরিষদ থেকে সাত কিলোমিটার দূরে সুমন্তপাড়া। পাঁচ কিলোমিটার মোটরসাইকেলে ও দুই কিলোমিটার হেঁটে পৌঁছাতে হয় ওই পাড়ায়। পাড়ায় ৭০টির মতো পরিবারের বসবাস। নতুন কেউ সেখানে ঢুকলেই পাড়াবাসী কৌতূহলী হয়ে জানতে চান, মণিকা চাকমার বাড়ি যাবেন?
বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৯ দলের মিডফিল্ডার মণিকা চাকমা কেবল তাঁর গ্রামেই নয়, উপজেলার সব মানুষের কাছেই এখন পরিচিত নাম। মণিকার বাড়ি যেতে হলে ঠিকানা না জানলেও চলবে। লক্ষ্মীছড়ি সদরে এসে কোনো যানবাহনে উঠে পড়লে সেটিই সুমন্তপাড়ার কাছাকাছি নিয়ে যাবে। এরপর হাঁটাপথে সঙ্গ দেবে এলাকার মানুষ। পৌঁছে দেবে বাড়ির দোরগোড়া পর্যন্ত। কারণ, এখন মণিকা এই উপজেলার গর্ব।
লক্ষ্মীছড়ি বাজারে কথা হচ্ছিল স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে। মণিকার বাড়ির ঠিকানা তাঁরাই বাতলে দিলেন। আর কথায় কথায় জানা গেল, ফিফার দর্শক জরিপের সেরার তালিকায় ওঠা তাঁর গোলের খবরও রাখেন তাঁরা। ইউটিউবসহ সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া বঙ্গমাতা অনূর্ধ্ব-১৯ আন্তর্জাতিক গোল্ডকাপের সেমিফাইনালে মঙ্গোলিয়ার বিপক্ষে মণিকার গোলটি অনেকেই দেখেছেন। সেটার প্রসঙ্গে উঠতেই বাজারের চায়ের দোকানের কাস্টমার থেকে শুরু করে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী সবার চোখই কপালে ওঠে। বিস্ময়ভরা চোখে তাঁরা বলেন, কী দুর্দান্ত গোলই না করল!
মণিকার গ্রাম সুমন্তপাড়ায় এখনো বিদ্যুৎ যায়নি। নেই সুপেয় পানির ব্যবস্থা। পাড়াবাসীর আশা, মণিকার কল্যাণে পাড়ার এসব সমস্যা দূর হবে।
পাড়ার শেষ সীমানায় পাহাড় ঘেঁষে মণিকা চাকমার বাড়ি। গত ২২ মে সুমন্তপাড়ায় বাড়িতে বসে কথা হয় মণিকা ও তাঁর মা-বাবার সঙ্গে। মণিকা শোনালেন মাঠ আর বলের তাঁর বন্ধুত্বের গল্প। ‘অনেকটা নিজের অজান্তেই হয়েছে। শৈশবে চাচাতো ভাই কিরণ চাকমা, সৃজন চাকমা ও বড় বোন অনিকা চাকমার সঙ্গে মাঠে ফুটবল খেলতে যেতাম। সেই থেকেই ফুটবলের প্রতি ভালোবাসা। যখনই সুযোগ পেয়েছি, খেলেছি পাড়ার ছেলেদের সঙ্গে।’ ফুটবলের পাশাপাশি ভলিবল, ক্রিকেট ও টেনিসও ভালোবাসেন মণিকা।
২০১১ সালে লক্ষ্মীছড়ি মনাচেঙ্গী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ার সময় মণিকা চাকমার সুযোগ হয় বঙ্গমাতা ফুটবল টুর্নামেন্টে খেলার। পরের বছর বিভাগীয় পর্যায়ে চট্টগ্রামে খেলতে গেলে রাঙামাটির ঘাগড়ার শিক্ষক বিরসেন চাকমার নজরে পড়েন তিনি। ২০১৩ সালে শিক্ষক বিরসেন তাঁকে ঘাগড়া উচ্চবিদ্যালয়ে ভর্তি করিয়ে দেন। মণিকা এখন ঘাগড়া কলেজে পড়ছেন উচ্চমাধ্যমিক দ্বিতীয় বর্ষে।
মণিকার বাবা বিন্দু কুমার চাকমাকে অভাবের সঙ্গে নিত্য লড়তে হয়। মেয়ের সাফল্যে এখন অবস্থা ধীরে ধীরে পরিবর্তন হচ্ছে। বাঁশ ও টিনের তিন কক্ষের নতুন বাড়ি উঠছে। ঘরে এসেছে সোলার প্যানেল ও টেলিভিশন।
মা রবিমালা বাইরের কাজ করে সন্ধ্যায় এসে দেখতেন ঘরের কাজ পড়ে আছে। রবিমালা মেয়ের কারণে নিজেকে ভাগ্যবান মনে করেন। মেয়ের জন্য তাঁদের পরিবারে এসেছে কিছুটা সচ্ছলতা। তবে এখনো তাঁদের পানির জন্য যেতে হয় দেড় কিলোমিটার দূরে।
তবে মণিকার স্বপ্ন কেবল তাঁর পরিবারের অবস্থার পরিবর্তন নয়, তিনি চান উপজেলাটাই বদলে যাক। মডেল উপজেলা হয়ে উঠুক লক্ষ্মীছড়ি। ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ যাক। তবে সব ছাপিয়ে তিনি স্বপ্ন দেখেন, বাংলাদেশের মেয়েরা একদিন বিশ্বকাপে অংশ নেবেন।