কক্সবাজার
মেয়রের নামে মামলা, ৪ ঘণ্টার জন্য অচল শহর
সন্ধ্যায় মেয়রের অনুসারীরা প্রধান সড়কে টায়ার জ্বালিয়ে, আড়াআড়িভাবে ময়লার গাড়ি রেখে বিক্ষোভ করেন এবং যান চলাচল বন্ধ করে দেন।
একটি হত্যাচেষ্টা মামলার জের ধরে গতকাল রোববার সন্ধ্যা থেকে চার ঘণ্টার জন্য প্রায় অচল হয়ে পড়ে পর্যটন শহর কক্সবাজার। পৌর মেয়র ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মুজিবুর রহমানকে হত্যাচেষ্টা মামলার প্রধান আসামি করার খবর ছড়িয়ে পড়লে সন্ধ্যায় মেয়রের কয়েক হাজার অনুসারী ও দলীয় নেতা-কর্মী-সমর্থক রাস্তায় নেমে আসেন। তাঁরা শহরের প্রধান সড়কে টায়ার জ্বালিয়ে বিক্ষোভ করেন। এ সময় সড়কের দুই পাশের কয়েক হাজার দোকানপাট বন্ধ হয়ে যায়। অনির্দিষ্টকালের জন্য সড়ক অবরোধ ঘোষণা করা হয়। বন্ধ হয়ে যায় যান চলাচল।
অচলাবস্থা নিরসনে জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে রাতে শহরের হিলডাউন সার্কিট হাউসে পুলিশ প্রশাসন, স্থানীয় সাংসদ ও জেলা আওয়ামী লীগের বৈঠক হয়। বৈঠকে ভ্রমণে আসা পর্যটক ও সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ লাঘবে সড়ক অবরোধ প্রত্যাহারের অনুরোধ করা হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে রাত সাড়ে নয়টায় অবরোধ তুলে নেন মেয়রের সমর্থকেরা। আজ সোমবার সকাল ১০টার মধ্যে মামলা প্রত্যাহার করা না হলে পুনরায় সড়ক অবরোধের হুঁশিয়ারি দিয়েছেন মেয়রের অনুসারীরা।
পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) আনোয়ার হোসেন গতকাল রাতে মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, সড়ক থেকে সব প্রতিবন্ধকতা অপসারণ করা হয়েছে। যান চলাচল স্বাভাবিক। পর্যটকদের ফিরতে কোনো অসুবিধা নেই। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ঘটনার সঙ্গে জড়িত কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।
গতকাল সন্ধ্যার পর সমুদ্রসৈকত ও হোটেল-মোটেল জোনে কয়েক শ দোকানপাট, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া হয়। হোটেল-রেস্তোরাঁ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সৈকতে ভ্রমণে আসা ৫০ হাজারের বেশি পর্যটক বিপাকে পড়েছেন বলে জানিয়েছেন কক্সবাজার হোটেল-মোটেল গেস্টহাউস মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবুল কাশেম সিকদার। তিনি বলেন, সড়কের বিভিন্ন স্থানে টায়ার জ্বালিয়ে ব্যারিকেড দেওয়ায় এবং পৌরসভার ময়লার গাড়ি রেখে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করায় দূরপাল্লার শতাধিক বাস আটকা পড়ে। রাতের এসব বাসে চড়ে অন্তত চার হাজার পর্যটকের কক্সবাজার ত্যাগের কথা ছিল। অবশ্য জেলা প্রশাসনের সঙ্গে আওয়ামী লীগের বৈঠকের পর রাত ১০টা থেকে পুনরায় বাস চলাচল শুরু হয়।
থানা-পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, গত ২৭ অক্টোবর রাতে জেলা ছাত্রলীগের সাবেক নেতা মোনাফ সিকদারকে গুলি করার ঘটনায় গতকাল বেলা দুইটার দিকে কক্সবাজার সদর মডেল থানায় হত্যাচেষ্টার মামলা হয়। মামলাটি করেন মোনাফ সিকদারের বড় ভাই মো. শাহজাহান। মামলায় গুলি করার নির্দেশদাতা হিসেবে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মুজিবুর রহমানকে ১ নম্বর ও জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক নাজনীন সরওয়ার কাবেরীকে ২ নম্বর আসামি করে আটজনের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। এ ছাড়া অজ্ঞাতনামা আরও সাত-আটজনকে আসামি করা হয়। বিকেল সাড়ে পাঁচটার দিকে মামলা গ্রহণের খবর ছড়িয়ে পড়লে মুজিবুর রহমানের কয়েক হাজার অনুসারী, দলীয় নেতা-কর্মী ও সমর্থক রাস্তায় নেমে আসেন। এ সময় তাঁরা মিথ্যা মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল ও প্রতিবাদ সমাবেশ করেন।
মামলার বাদী মো. শাহজাহান বলেন, গত বুধবার জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সহসভাপতি মোনাফ সিকদার সমুদ্রসৈকতের সুগন্ধা পয়েন্টে শুঁটকি মার্কেটে মোটরসাইকেল নিয়ে গেলে দুর্বৃত্তরা গুলি করে পালিয়ে যায়। গুলিটি মোনাফ সিকদারের পেটের এক পাশ দিয়ে ঢুকে অন্য পাশ দিয়ে বেরিয়ে যায়। বর্তমানে মোনাফ সিকদার চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন, তাঁর অবস্থা আশঙ্কাজনক।
চিকিৎসারত মোনাফ সিকদার গত শনিবার এক ভিডিও বার্তায় বলেন, ‘আমাকে মুজিবুর রহমান মেয়রের নির্দেশে গুলি করা হয়েছে। ওরা (দুর্বৃত্তরা) গুলি করার সময় বলছিল, “তুই মুজিব চেয়ারম্যানের সাথে লাগছিস? মুজিব চেয়ারম্যানের সাথে আর লাগবি?” এই বলে পেছন থেকে গুলি করে পালিয়ে যায়।’
জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মাহবুবুর রহমান চৌধুরী বলেন, সমুদ্রসৈকতে সুগন্ধা পয়েন্টে শুঁটকি মার্কেট দখলের ঘটনায় দুটি পক্ষ জড়িত। একটি পক্ষে মোনাফ সিকদারের অবস্থান। সম্ভবত একটি পক্ষ তাঁকে গুলি করে। এখন রাজনৈতিক একটি পক্ষ মোনাফ সিকদারের মুখ দিয়ে মুজিবুর রহমানের নাম বলিয়ে তাঁকে বিতর্কিত করার চেষ্টা করছে।
গতকাল সন্ধ্যা সাতটার দিকে কলাতলীর শ্যামলী কাউন্টারে ১০-১৫ জন পর্যটককে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেল। সবাই রাত নয়টার বাসে ঢাকায় ফেরার টিকিট করেছিলেন। কিন্তু বাসের দেখা নেই। বাস কাউন্টারের সামনের রাস্তায় টায়ার জ্বালিয়ে সড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
ঢাকার মগবাজার থেকে ভ্রমণে আসা ব্যবসায়ী নজরুল ইসলাম বলেন, গত ২৭ অক্টোবর পরিবারের পাঁচ সদস্য নিয়ে তিনি বাসে কক্সবাজারে আসেন। টেকনাফ, মহেশখালী, রামু ঘুরে রোববার রাত ১০টায় গ্রিনলাইন পরিবহনে ঢাকায় ফেরার টিকিট করেছিলেন। সন্ধ্যার পর কাউন্টারে এসে বাস ছাড়বে না শুনে উদ্বেগে ছিলেন।
এদিকে হত্যাচেষ্টা মামলার আসামি হওয়া প্রসঙ্গে কক্সবাজার পৌরসভার মেয়র মুজিবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ছাত্রলীগের সাবেক ক্যাডার মোনাফ সিকদারকে যখন গুলি করা হয়, তখন তিনি (মেয়র) ঢাকায় ছিলেন। সামনে জেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলন। সম্মেলন ঘিরে তাঁকে বিতর্কিত করতে, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ তাঁকে সামাজিকভাবে হেয় এবং ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করতে মিথ্যা মামলায় আসামি করেছে। তিনি আরও বলেন, শহরে কারা আন্দোলন করছে, দোকানপাট কে বন্ধ করছে—এসব তাঁর জানা নেই।
মামলার ২ নম্বর আসামি জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক নাজনীন সরওয়ার কাবেরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘আওয়ামী লীগের একজন একনিষ্ঠ কর্মী হওয়ার পরও আমি যদি মিথ্যা মামলার আসামি হই, তাহলে সাধারণ নাগরিকের কী অবস্থা, তা সহজে আন্দাজ করা যায়। মোনাফ সিকদারের ভাইয়ের মামলায় আমি আসামি হব, স্বপ্নেও ভাবিনি।’
জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি (ভারপ্রাপ্ত) ফরিদুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও পৌরসভার একজন মেয়রের বিরুদ্ধে হত্যাচেষ্টা মামলা গ্রহণের আগে ঘটনার সত্য-মিথ্যা যাচাই করা উচিত ছিল পুলিশের। এখন তা না করে মামলা গ্রহণ করায় কক্সবাজারের পরিস্থিতি অশান্ত ও উত্তপ্ত হয়ে গেল। মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার না হওয়া পর্যন্ত এই অচলাবস্থা চালিয়ে যাওয়ার হুমকি দিচ্ছেন আন্দোলনকারীরা।
মামলার বিষয়ে জানার জন্য একাধিকবার যোগাযোগ করেও কক্সবাজার সদর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শেখ মুনীর-উল-গীয়াসের বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
মামলা গ্রহণের সত্যতা নিশ্চিত করে কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) মো. রফিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, যেকোনো নাগরিকের বিরুদ্ধে থানায় মামলা হতে পারে। এই মামলাও সে রকমভাবে হয়েছে, তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। শহরের পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে পুলিশ মাঠে নেমেছে।