স্বজন হারানো পরিবারের ঈদ
মাইশাকে ছাড়া ঈদ হবে কীভাবে
নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি অনুষ্ঠানে যাওয়ার পথে গত ১ এপ্রিল রাজধানীর কুড়িল বিশ্বরোডে ট্রাকচাপায় নিহত হন মাইশা মমতাজ।
‘মাইশা বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করলেও ছোট মেয়ে মৌয়ের চেয়ে ওর বায়না ছিল বেশি। তবে তার সেই বায়না নিজের জন্য ছিল না, ছিল গরিব-দুঃখী মানুষকে সহায়তা করার বায়না। ঈদ ছাড়াও সব সময় সুবিধাবঞ্চিত মানুষকে সহযোগিতা করা ছিল তার নেশা। এবার ঈদ এসেছে, কিন্তু মাইশা নেই। ওকে ছাড়া আমাদের ঈদ হবে কীভাবে?’
গতকাল শনিবার গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার মৌচাক এলাকায় নিজ বাসায় কথা হয় মাইশা মমতাজের (২৪) বাবা নূর মোহাম্মদ ও মা আছমা বেগমের সঙ্গে। মেয়ের স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে তাঁরা এসব কথা বলেন। একপর্যায়ে কথা বলতে বলতে তাঁরা দুজনেই কান্নায় ভেঙে পড়েন।
স্কুটি চালিয়ে উত্তরার বাসা থেকে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি অনুষ্ঠানে যাওয়ার পথে গত ১ এপ্রিল রাজধানীর কুড়িল বিশ্বরোডে ট্রাকচাপায় নিহত হন মাইশা মমতাজ। মাইশা নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলেন।
ওই দিন মাইশার ছোট বোন মৌয়ের মেডিকেলে ভর্তি পরীক্ষা ছিল। তাই সকালে বাবা নূর মোহাম্মদ তাঁকে নিয়ে মিরপুরের বাঙলা কলেজে পরীক্ষাকেন্দ্রে চলে যান। মাইশা সকালেই বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে নিজের স্কুটি নিয়ে বেরিয়ে যান। সকাল ১০টার দিকে তাঁর (নূর মোহাম্মদ) মুঠোফোনে একটি ফোন আসে, ‘আপনার মেয়ে অ্যাকসিডেন্ট করেছে, আপনি হাসপাতালে আসেন।’ হাসপাতালে গিয়ে মেয়ের লাশ দেখে সংজ্ঞাহীন হয়ে যান তিনি। আর তাঁর মাকে জানানো হয় বিকেল সাড়ে পাঁচটায় মেয়ের জানাজা পড়ানোর কিছু আগে। মেয়ের মৃত্যুসংবাদ পেয়ে মা-ও জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন।
মাইশার মা আছমা বেগম কথা বলছিলেন আর চোখ দিয়ে পানি পড়ছিল। তিনি কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ঈদের আগে কত কী বায়না থাকত
তাঁর মেয়ের, সেই বায়না করার মতো কেউ নেই। তিনি নিজের জন্য কিছুই চাইতেন না, যত বায়না সব মানুষকে দেওয়ার জন্য। আর তাঁর বাবাও মাইশার কথামতো গরিব মানুষকে এটা-সেটা বিলিয়ে দিতেন।
মাইশা মমতাজের বাবা নূর মোহাম্মদ প্রথম আলোকে বলেন, ডাক্তারি, ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার যোগ্যতা থাকলেও ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হয়েছিলেন মাইশা। মানুষের পাশে থাকার প্রবল ইচ্ছা ছিল তাঁর। মাইশা বলতেন, ‘আমাদের তো যথেষ্ট টাকাপয়সা আছে, আমার টাকাপয়সা নিজের জন্য প্রয়োজন নেই, যা কিছু উপার্জন করব, সবটুকু গরিব-অসহায় মানুষের মধ্যে বিলিয়ে দেব।’
মাইশার স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে মাইশার বাবা আরও বলেন, ‘মাইশা কখনো রিকশায় উঠলে ভাড়ার কথা জিজ্ঞেস করত না, রিকশাচালক যা চাইতেন তা-ই দিত। প্রয়োজনে কিছু বেশি দিত। আবার আমাকেও বলত, “আব্বু তুমিও কখনো রিকশায় উঠলে ভাড়া নিয়ে দামাদামি করবা না, যা চাইবে তা-ই দেবে।” রিকশায় উঠলেই মেয়ের কথা কানে বেজে ওঠে।’
মা আছমা বেগম বলেন, ‘মাইশা বিরিয়ানি খেতে খুব পছন্দ করত। যখনই মন চাইত বলত, “আম্মু বিরিয়ানি রান্না করো।” একবারের
রান্না ফ্রিজে রেখে কখনো দুই-তিনবার খেত। কোনো সময় রান্না করতে না চাইলে দোকান থেকে কিনে খেত।’
মাইশা মমতাজ পরিবারের বড় মেয়ে। তিনি তাঁর বাবার প্রতিষ্ঠিত কালিয়াকৈরের মৌচাক আইডিয়াল পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এসএসসি ও এইচএসসি পাস করেন। এরপর ভর্তি হন নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে।
মাইশার বাবার বন্ধু সফিপুর আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান হাবিবুর রহমান বলেন, মাইশা শিক্ষার্থী হিসেবে খুবই মেধাবী ছিলেন। তিনি সব সময় সমাজ ও মানুষের জন্য কিছু করতে চাইতেন।