ভোলা শহর রক্ষা বাঁধে ফের ধস
মেঘনা নদীর তীরে ভাঙন ঠেকাতে ১৯৯৮-২০০৪ সালে দুই দফায় ৩ হাজার ৩০০ মিটার ব্লক বাঁধ নির্মাণ করা হয়।
ভোলা শহর রক্ষা বাঁধে আবার ধস দেখা দিয়েছে। তীর সংরক্ষণ ব্লক বাঁধের তুলাতুলি এলাকার দুই কিলোমিটার অংশ ধসে মাটি বের হয়ে গেছে। ফলে স্থানীয় বাসিন্দারা আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন। তাঁদের অভিযোগ, ধসে যাওয়া বাঁধে নতুন করে ব্লক না দিয়ে বালুভর্তি বস্তা ফেলে নামকাওয়াস্তে সংস্কার করা হয়েছে। ফলে কয়েক মাস পরই আবার তা ধসে যাচ্ছে। দ্রুত সংস্কার না হলে যেকোনো সময় ভোলা শহরে পানি ঢোকার আশঙ্কা রয়েছে।
ভোলা পানি উন্নয়ন বোর্ড-১ (পাউবো) সূত্র জানায়, মেঘনা নদীর তীরে ভাঙন ঠেকাতে ১৯৯৮-২০০৪ সালে দুই দফায় তুলাতুলি মুন্সিবাড়ি (শাহবাজপুর পর্যটনকেন্দ্র) থেকে উত্তরে বালিয়াকান্দি দফাদারবাড়ি পর্যন্ত ৩ হাজার ৩০০ মিটার ব্লক বাঁধ নির্মাণ করা হয়। বাঁধের প্রস্থ ছিল ৩৪ মিটার। ভোলা সদর উপজেলার শিবপুর, ধনিয়া, কাচিয়া, পূর্ব ইলিশা ও রাজাপুর ইউনিয়নের চরমোহাম্মাদ আলীর পশ্চিমপাড় পর্যন্ত ভোলা শহর রক্ষা বাঁধ (বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ) ধরা হয়। যার দৈর্ঘ্য প্রায় ২৩ কিলোমিটার। এর মধ্যে মাত্র আট কিলোমিটারে মেঘনা তীর সংরক্ষণ ব্লক বাঁধ রয়েছে। আরও ১৫ কিলোমিটারে ব্লক বাঁধ দরকার।
গত বৃহস্পতিবার সরেজমিনে দেখা যায়, গুরুত্বপূর্ণ অংশ ধসে মাটি বের হয়েছে। ঢেউয়ের ঝাপটায় মাটি ক্ষয়ে যাচ্ছে। দুই কিলোমিটারে চার-পাঁচটি স্থান একদম ধসে গেছে। ওই অংশে কোনো ব্লক নেই। বাকি অংশে প্রস্থে ৩৪ মিটার ব্লক থাকার কথা থাকলেও আছে ১ থেকে ৩ মিটার। বিলীন হওয়া উল্লেখযোগ্য অংশ হচ্ছে লঞ্চঘাটের পাশে মতিউর রহমান গোলদারবাড়ি মসজিদ ও বাড়ির কোনাকুনি বরাবর, গোলদারবাড়ির সামনে খেয়াঘাট, পণ্ডিতবাড়ি, তুলাতুলি জামে মসজিদের সামনে ও শাহবাজপুর পর্যটনকেন্দ্র এলাকা।
স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ধসে যাওয়া স্থানে বালুভর্তি বস্তা ফেলা হয়েছে, সে বস্তা পানিতে ভাসছে। নৌকাগুলোর নোঙর বস্তার ওপর ফেলায় এ অবস্থা হয়েছে। পাউবোর প্রকৌশলীরা পরিদর্শন করে বালুর বস্তা ফেললে শীত আসতে না আসতেই আবার যা তা–ই। এখন ভয়াবহ অবস্থা। বস্তার মধ্যে মেঘনা নদীর চিকন দানার ভিটিবালু দিচ্ছে। চিকন দানার বালু বস্তায় ভরে ভাঙন মোকাবিলা করছে। তাই বস্তাগুলো টিকছে না।
পাউবো সূত্র জানায়, বর্তমানে ভোলা শহর রক্ষা বাঁধের তুলাতুলি লঞ্চঘাট থেকে মুন্সিবাড়ি পর্যন্ত বাঁধ অধিক ঝুঁকিপূর্ণ। ২০১৯ সালে এ শহর রক্ষা বাঁধের ২৫০ মিটার বাঁধ সংস্কারের জন্য অধিদপ্তরে ২ কোটি ৭০ লাখ টাকার চাহিদা পাঠালে ৪৯ লাখ টাকা বরাদ্দ আসে। ওই টাকায় ঠিকাদার ৯ হাজার ৭২টি বালুভর্তি বস্তা (জিও ব্যাগ) ডাম্পিং করেছে। ঘূর্ণিঝড় আম্পান-বুলবুল ও জলোচ্ছ্বাসে বাঁধের আরও ক্ষতি হয়। ব্লক ও বস্তা ধসে নষ্ট হলে ২০২০ সালে ভোলা পাউবো আবার ৭৯ কোটি টাকার চাহিদা পাঠায়। তবে বরাদ্দ হয় মাত্র ৭৯ লাখ ৮৩ হাজার টাকা। এ টাকায় ১৫ হাজার ২৯৮টি বস্তা ফেলা হয়। ২০২১ সালে ইয়াসসহ একাধিক ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাস ও উচ্চ জোয়ারে ক্ষতিগ্রস্ত ওই দুই কিলোমিটার ব্লক বাঁধের আরও ক্ষতি হয়েছে। এবার বাঁধটি সংস্কারের জন্য আট কোটি টাকা চাইলে এখনো কোনো বরাদ্দ দেওয়া হয়নি।
পাউবো সূত্র আরও জানায়, ২০১৮ সাল থেকে ভোলা সদর উপজেলার ভাঙনকবলিত এলাকার মেঘনা নদীর তীর সংরক্ষণে অধিদপ্তরে ১ হাজার ৫৫০ কোটি টাকার প্রকল্প-নকশা একাধিকবার জমা দেওয়া হয়। কিন্তু আজও অনুমোদিত হয়নি।
বাঁধ এলাকার বাসিন্দা নিজাম উদ্দিন গোলদার বলেন, ‘আমগো বাড়ির সাড়ে ১৫ আনা নদী ভাঙনে লোই গেছে। পোইখের আদারের নাইন এক টুকরা জমিত পৈতৃক বাড়ির নিশানা রই গেছে। হেও ভাঙনের মুহে পোইররাও ২২-২৩ বছর ব্লকের উছিলায় আল্লায় টিকাইয়া রাখছে। নিরাপদে আছিলাম। আমাবইস্যা-পূর্ণিমায় জোয়ারে পানির দমায় (ঢেউ) ব্লক ধসি গেছে। বর্ষায় জোয়ারের ঢেউ মাডির বান্ধে গিয়া বারি দেয়। আমগো এহন চোকখে ঘুম নাই। জানি না এই বর্ষায় বান (তীর সংরক্ষণ বাঁধ) থাকপো কি না।’
তুলাতুলি মাছঘাটের আড়তদার আবু তাহের দালাল বলেন, একাধিক ভাঙনের পরে ব্লক বাঁধ হওয়ার পর তুলাতুলি লঞ্চঘাট এলাকায় মাছঘাটে মৎস্য আড়তদারদের ব্যবসা জমে ওঠে। পাকাপোক্তভাবে তাঁরা আড়ত গড়ে তুলেছেন। ঘাটের সামনের রাস্তা পাকা হয়েছে। এখন সে বাঁধে ধস লেগেছে। ব্যবসায়ীরা আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন।
পাউবো-১-এর নির্বাহী প্রকৌশলী মুহাম্মদ হাসানুজ্জামান বলেন, তুলাতুলি তীর সংরক্ষণ বাঁধ সংস্কারে কোনো বরাদ্দ আসেনি। ইতিপূর্বে ফেলা বালুভর্তি বস্তা জেলেনৌকা, ট্রলার ও লঞ্চের ধাক্কায় ফুটো হয়ে বালু বেরিয়ে গেছে। বস্তায় বালুর সঙ্গে সিমেন্ট দেওয়া হলে হয়তো আর নষ্ট হবে না।