‘ভূমিহীন সনদ’ পেতে পেতে চাকরির সুযোগটাই হারালেন হাসান

হাসান সিদ্দিকী

উত্তরাধিকার সূত্রে কোনো সম্পত্তি পাননি ওমর সিদ্দিকী। ভাড়া বাসায় থেকে কাটছে জীবন। এরই মধ্যে অনার্সপড়ুয়া ছেলে মো. হাসান সিদ্দিকী (২০) পুলিশ কনস্টেবল পদে চাকরির আবেদন করেন। পরীক্ষার সব কটি ধাপও উতরে যান তিনি। কিন্তু সময়মতো ‘ভূমিহীন সনদ’ না পাওয়ায় চাকরিতে যোগ দিতে পারেননি তিনি।

হাসান সিদ্দিকী মা, বাবা ও ছোট ভাইকে নিয়ে থাকেন ঢাকার সাভার পৌর এলাকার বিনোদবাইদ এলাকায়। ধামরাই সরকারি কলেজে স্নাতক প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী তিনি। পুলিশের ট্রেইনি রিক্রুট কনস্টেবল পদের পরীক্ষায় তাঁর সঙ্গে উত্তীর্ণ সবাই গতকাল বৃহস্পতিবার প্রশিক্ষণে গেছেন। কিন্তু যথাসময়ে ভূমিহীন হওয়ার প্রত্যয়নপত্র না পাওয়ায় তিনি আটকে যান।

এ বিষয়ে ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার (এসপি) মারুফ হোসেন সরদার প্রথম আলোকে বলেন, ভূমিহীন যাঁরা তাঁরা উপজেলা এসি ল্যান্ডের (সহকারী কমিশনার–ভূমি) কাছ থেকে সনদ নিয়ে দিলেই তাঁদের নিয়ে নিয়েছেন। কিন্তু হাসান সিদ্দিকীর এ ধরনের কোনো সনদ না থাকায় নিয়ম অনুযায়ী তাঁকে সুযোগ দিতে পারেননি। গতকাল সকালেও যদি তাঁদের জানানো হতো তবে তাঁদের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে সর্বাত্মক সহযোগিতা করা হতো।

গতকাল সন্ধ্যায় সাভারের বিনোদবাইদ এলাকায় ভাড়া বাসায় কথা হয় মো. হাসানের সঙ্গে। তাঁর দাবি, গত বুধবার এবং গতকাল সকালে সাভার উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) মোহাম্মদ রহমত উল্লাহর কাছে ভূমিহীন প্রত্যয়নপত্রের জন্য যান তিনি। কিন্তু ভূমিহীন প্রত্যয়নপত্র দেওয়ার নিয়ম নেই জানিয়ে পৌরসভার ওয়ার্ড কমিশনার ও মেয়রের কাছ থেকে প্রত্যয়নপত্র নিলেই হবে বলে জানিয়ে দেন তিনি। তবে পৌরসভা থেকে সনদ নেওয়া হলেও সেটি পর্যাপ্ত না হওয়ায় বাদ পরেন তিনি।

যথাসময়ে প্রত্যয়নপত্র পেলে আমি বাদ যেতাম না। সব ধরনের যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও শুধু একটি সনদের কারণে আমি বাদ পড়েছি।
হাসান সিদ্দিকী

উপায় না পেয়ে গতকাল সন্ধ্যার দিকে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার সঙ্গে দেখা করে বিস্তারিত জানান হাসান। পরে ইউএনওর নির্দেশে রাত সাড়ে ১১টার দিকে সহকারী কমিশনার (ভূমি) মোহাম্মদ রহমত উল্লাহ হাসানকে ভূমিহীন প্রত্যয়নপত্র দেন।

এর আগে গতকাল রাত সাড়ে আটটায় উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) মোহাম্মদ রহমত উল্লাহ প্রথম আলোকে বলেছিলেন, ‘আমি ঢাকায় মিটিংয়ে ছিলাম। এখন রাস্তায়, সবকিছু প্রস্তুত করা আছে পৌঁছে স্বাক্ষর করব।’

হাসান সিদ্দিকী প্রথম আলোকে বলেন, ‘যথাসময়ে প্রত্যয়নপত্র পেলে আমি বাদ যেতাম না। সব ধরনের যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও শুধু একটি সনদের কারণে আমি বাদ পড়েছি। পুলিশ প্রশাসনের কাছে অনুরোধ জানাচ্ছি, মানবিক দিক বিবেচনা করে আমাকে সুযোগ দেওয়ার।’

পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, হাসানের বাবা প্রদীপ কুমার সাহা ২০০২ সালে পরিবারসহ ধর্মান্তরিত হয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে হাসানের দাদা তাঁদের পরিবারকে বিচ্ছিন্ন করে দেন। এরপর পরিবারসহ বিনোদবাইদে একটি ভাড়া বাসায় ওঠেন তাঁরা। তাঁর বাবা ওমর সিদ্দিকী একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চিত্রগ্রাহক।

হাসান জানান, গত সেপ্টেম্বরে ঢাকা জেলায় পুলিশের ট্রেইনি রিক্রুট কনস্টেবল পদে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেখে আবেদন করেন। ১৪ নভেম্বর শারীরিক যোগ্যতা এবং ১৫ ও ১৬ নভেম্বর শারীরিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। পরদিন লিখিত পরীক্ষায়ও উত্তীর্ণ হন। ২৪ নভেম্বর একই স্থানে মৌখিক পরীক্ষায় অংশ নিয়ে মেধাতালিকায় ১১৫তম হন তিনি। পরে ২৯ নভেম্বর প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও ৩ ডিসেম্বর রাজারবাগ কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালে চূড়ান্ত স্বাস্থ্য পরীক্ষা হলে সেখানেও উত্তীর্ণ হন। চূড়ান্ত নিয়োগের জন্য সব ভেরিফিকেশনও সম্পন্ন হয়। এরপর চলতি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে পুলিশের পক্ষ থেকে মুঠোফোনে কল করে জামা, জুতা, ট্রাউজার ও কেডসের মাপ নেওয়া হয়। এর পর থেকে পুলিশে যোগ দেওয়ার চূড়ান্ত মানসিক প্রস্তুতি নেন তিনি।

হাসান বলেন, উত্তীর্ণ অন্য বন্ধুদের মাধ্যমে কোভিড পরীক্ষা করানো হচ্ছে জানতে পেরে তিনি বুধবার পুলিশ কেন্দ্রীয় মিল ব্যারাকে উপস্থিত হন। পরে সবাইকে রাজারবাগ কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালে পাঠানো হয়। কিন্তু তাঁকে না পাঠানোয় তিনি দায়িত্বরত পুলিশ কর্মকর্তাদের কাছে বিষয়টি জানতে চান। পরে তাঁকে ‘ভূমিহীন’ হওয়ায় বাদ দেওয়া হয়েছে বলে জানানো হয়। এরপর হাসান ঢাকা জেলা পুলিশ সুপার মারুফ হোসেন সরদারের সঙ্গে দেখা করতে যান। তবে তখন তিনি বাইরে থাকায় বিষয়টি জানানো সম্ভব হয়নি।

কান্নাজড়িত কণ্ঠে হাসান সিদ্দিকী প্রথম আলোকে বলেন, ‘শিক্ষাগত যোগ্যতাসহ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে আমি যোগ্যতার প্রমাণ দিলেও শুধু ভূমিহীন সনদ না থাকায় আমার সারা জীবনের স্বপ্ন আজ ভেঙে গেল। আমার সঙ্গে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ সবাই ট্রেনিংয়ের জন্য চলে গেল, আমি যেতে পারলাম না।’