ভাসানচরের উদ্দেশে চট্টগ্রাম যাচ্ছে রোহিঙ্গাদের গাড়িবহর
‘চল চল ভাসানচর চল’ স্টিকারযুক্ত ছোট-বড় বিভিন্ন ধরনের যানবাহনে কক্সবাজারের বিভিন্ন ক্যাম্প থেকে রোহিঙ্গাদের নেওয়া হচ্ছে চট্টগ্রাম। সেখান থেকে নৌপথে পাঠানো হবে নোয়াখালীর ভাসানচর আশ্রয়কেন্দ্রে।
আজ বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টা ২০ মিনিটে উখিয়া ডিগ্রি কলেজ মাঠ থেকে রোহিঙ্গাবোঝাই ১৭টি যানবাহন সারিবদ্ধভাবে ভাসানচরের উদ্দেশে চট্টগ্রাম রওনা দিয়েছে। এসব পরিবহনে সাড়ে আট শর বেশি রোহিঙ্গা আছেন। রাত আটটা নাগাদ পরিবহনগুলো চট্টগ্রামে পৌঁছাবে।
বিকেলের দিকে আরও কিছু বাসে করে হাজার খানেক রোহিঙ্গার চট্টগ্রামের উদ্দেশে রওনা হওয়ার কথা আছে। আগামীকাল শুক্রবার দ্বিতীয় দফায় আরও দেড় হাজার রোহিঙ্গাকে উখিয়া থেকে চট্টগ্রাম পাঠানো হবে। এরপর চট্টগ্রাম থেকে নৌবাহিনীর জাহাজে তিন হাজার রোহিঙ্গাকে নৌপথে ভাসানচরে নেওয়া হবে।
আজ সকাল আটটার দিকে উখিয়া ডিগ্রি কলেজ মাঠে গিয়ে দেখা যায়, একাধিক বাস-ট্রাকে করে উখিয়া-টেকনাফের বিভিন্ন ক্যাম্প থেকে রোহিঙ্গাদের এনে কলেজ মাঠে জড়ো করা হচ্ছে। আগের দিন গতকাল বুধবার রাতেও পাঁচ শতাধিক রোহিঙ্গাকে কলেজ ক্যাম্পাসে আনা হয়। দুপুরের দিকে রোহিঙ্গাবোঝাই বাস ও ট্রাকের বহর চট্টগ্রামের উদ্দেশে রওনা দেয়।
নোয়াখালীর ভাসানচরের উদ্দেশে চট্টগ্রামে তৃতীয় দফায় (প্রথম অংশে) সাড়ে আট শতাধিক রোহিঙ্গা রওনা হওয়ার কথা নিশ্চিত করেছেন শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ সামছুর-দ্দৌজা নয়ন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, দুদিনে (বৃহস্পতি ও শুক্রবার) ভাসানচরে পাঠানোর জন্য অন্তত তিন হাজার রোহিঙ্গা প্রস্তুত রাখা হয়েছে।
গত বছরের ৪ ও ২৯ ডিসেম্বর দুই দফায় ৩ হাজার ৪৪৬ জন রোহিঙ্গাকে ভাসানচরে স্থানান্তরিত করা হয়েছে। এর মধ্যে ৮০১ জন পুরুষ, ৯৮৭ জন নারী এবং ১ হাজার ৬৫৮টি শিশু। তার আগে গত বছরের মে মাসে অবৈধভাবে সাগরপথে মালয়েশিয়া যেতে ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসা ৩০৬ রোহিঙ্গাকে ভাসানচর নিয়ে যায় সরকার।
উখিয়ার তানজিমারখোলা রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাসিন্দা আবদুল কাদের (৫০) বলেন, তাঁদের শিবির থেকে আজ সকালে ভাসানচরে যাওয়ার জন্য দেড় শতাধিক নারী-পুরুষ ও শিশু উখিয়া কলেজ মাঠে গেছে। ভাসানচরে থাকা-খাওয়ার সুব্যবস্থার কথা শুনে কক্সবাজারের রোহিঙ্গারা সেখানে যেতে আগ্রহ দেখাচ্ছেন।
এ বিষয়ে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের প্রতিনিধি, উখিয়া কুতুপালং ক্যাম্প-২ ইস্টের রোহিঙ্গা শিবিরের কর্মকর্তা (ইনচার্জ) মো. রাশেদুল ইসলাম বলেন, তাঁর শিবির থেকে স্বেচ্ছায় ছয় শতাধিক রোহিঙ্গা ভাসানচরে যেতে প্রস্তুতি শেষ করেছেন।
প্রসঙ্গত, মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর হত্যা ও নির্যাতনের মুখে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট থেকে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেন সাড়ে সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা। বর্তমানে বাংলাদেশে ঠাঁই নেওয়া রোহিঙ্গার সংখ্যা ১০ লক্ষাধিক। রোহিঙ্গা আশ্রয়কেন্দ্রগুলোয় চাপ কমাতে দুই বছর আগে অন্তত এক লাখ রোহিঙ্গাকে নোয়াখালীর হাতিয়ার কাছে মেঘনা মোহনার ভাসানচরে স্থানান্তরের পরিকল্পনা নেয় সরকার।
সরকারি তথ্য অনুযায়ী, নৌবাহিনীর তত্ত্বাবধানে রোহিঙ্গা স্থানান্তরের জন্য নিজস্ব তহবিল থেকে ৩ হাজার ৯৫ কোটি টাকা ব্যয়ে ভাসানচর আশ্রয়ণ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। ১৩ হাজার একর আয়তনের ওই চরে এক লাখ রোহিঙ্গা বসবাসের উপযোগী ১২০টি গুচ্ছগ্রামের অবকাঠামো তৈরি করা হয়েছে। ভাসানচরের পুরো আবাসন প্রকল্প বাস্তবায়ন ও ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে রয়েছে বাংলাদেশ নৌবাহিনী।
চাপে নয়, স্বেচ্ছায় যাচ্ছেন ভাসানচরে
আজ সকালে সরেজমিনে উখিয়া ডিগ্রি কলেজ মাঠে দেখা যায়, কয়েক শ রোহিঙ্গা অবস্থান করছেন। তাঁরা গতকাল বিকেলে কুতুপালং, লম্বাশিয়া, হাকিমপাড়া, তানজিমারখোলা আশ্রয়কেন্দ্র থেকে উখিয়া ডিগ্রি কলেজে আসেন। মাঠে সারিবদ্ধভাবে রাখা হয়েছে অর্ধশতাধিক বড় বড় বাস।
রোহিঙ্গাদের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নেওয়ার জন্য রাখা হয়েছে ২৫ থেকে ৩০টি ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যান। রোহিঙ্গাদের বসার (বিশ্রাম) জন্য বিশাল একটি প্যান্ডেল তৈরির পাশাপাশি চেয়ারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এর পাশেই চলছে গরু জবাই করে রোহিঙ্গাদের খাবারের বিশাল আয়োজন। পুরো এলাকাজুড়ে আছে পুলিশ, র্যাব, এপিবিএন ও বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার কড়া নিরাপত্তা।
স্বেচ্ছায় ভাসানচরে যেতে ইচ্ছুক জামালদা বেগম, মমিনা খাতুন, আসাব উদ্দিন ও আমির হোসেনের সঙ্গে কথা হয়। তাঁরা বলেন, উখিয়া-টেকনাফের আশ্রয়কেন্দ্রগুলো নিরাপদ নয়। এখন প্রায় সময় অস্ত্রধারী রোহিঙ্গাদের আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে গুলিবিনিময় ও হামলার ঘটনা ঘটছে। তাই কারও চাপে নয়, স্বেচ্ছায় তাঁরা ভাসানচরে যাচ্ছেন।
উখিয়ায় তানজিমারখোলা আশ্রয়কেন্দ্র থেকে আসা কবির আহমদ বলেন, ভাসানচরে উন্নত মানের শেড তৈরি করা হয়েছে। টয়লেটসহ নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধা অনেক বেশি হওয়ায় অধিকাংশ রোহিঙ্গাই এখন বাসায় চলে যেতে ইচ্ছুক।
ভাসানচরে যাওয়ার অপেক্ষায় আছেন রোহিঙ্গা নুরুল ইসলাম। তিনি বলেন, আশ্রয়কেন্দ্রে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী, মাদক ব্যবসায়ী ও বখাটের উৎপাত বেড়েছে। খুনখারাবি, মুক্তিপণের জন্য অপহরণ, নারী ধর্ষণ ও ইয়াবার টাকা ভাগাভাগি নিয়ে প্রায়ই মারামারির ঘটনা ঘটছে। গত মঙ্গলবারও রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী দুটি দলের মধ্যে গোলাগুলিতে এক রোহিঙ্গা নিহত হয়েছেন। সাধারণ রোহিঙ্গারা অত্যাচার-নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। তাই ঝুঁকি এড়াতে রোহিঙ্গারা স্বেচ্ছায় ভাসানচরে যেতে আগ্রহ দেখাচ্ছেন।