পাবনা প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
ব্যয় বাড়লেও ভবন হয়েছে ছোট
১৮০ টাকা কোটি ব্যয় বাড়িয়েও শেষ হয়নি প্রকল্পের কাজ। সব মিলিয়ে ৪৮০ কোটি টাকার কাজে নানা অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে।
দুই তলাবিশিষ্ট আনসার ভবন নির্মাণের প্রাথমিক ব্যয় ধরা হয়েছিল ১ কোটি টাকা। পরে তা করা হয়েছে ১ কোটি ৪৬ লাখ টাকা। এরপরও ভবনটি দোতলার জায়গায় একতলা করা হয়।
তিনতলাবিশিষ্ট শিক্ষক কর্মকর্তা ক্লাবের প্রাথমিক নির্মাণ ব্যয় ছিল ৩ কোটি ৭৩ লাখ টাকা, পরে এটি ৪ কোটি ৫৩ লাখ টাকা করা হয়। কিন্তু ভবনটি তিনতলার জায়গায় হয়েছে দোতলা।
প্রায় ৩০০ কোটি টাকার প্রকল্পের ব্যয় বাড়িয়ে করা হয়েছে প্রায় ৪৮০ কোটি ৬০ লাখ টাকা। মেয়াদ বাড়ানোর পরও শেষ হয়নি কাজ। দশতলাবিশিষ্ট দুটি ভবনের কাজ হয়েছে মাত্র ৩০ শতাংশ। তিনতলাবিশিষ্ট ভবনের বদলে দোতলা; আবার দোতলার বদলে একতলাবিশিষ্ট ভবন নির্মাণের অভিযোগ উঠেছে। নির্মাণ ব্যয় বাড়লেও ভবনের আকার ছোট হয়ে গেছে। পরিবর্তন করা হয়েছে মহাপরিকল্পনা (মাস্টারপ্ল্যান)। ১০ কোটি টাকার বইয়ের প্রথম কিস্তি এসেছে, যা নিম্নমানের।
পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে চলমান উন্নয়ন প্রকল্প নিয়ে এসব অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে সদ্য যোগ দেওয়া উপাচার্য হাফিজা খাতুন উন্নয়ন প্রকল্পের ব্যবস্থাপনা কমিটির সঙ্গে প্রথম বৈঠকে এসব বিষয় তুলে ধরে বলেছেন, অনিয়মের কোনো দায় তিনি নেবেন না।
জানতে চাইলে উপাচার্য হাফিজা খাতুন প্রথম আলোকে বলেন, ‘উন্নয়ন প্রকল্পের প্রতিটি কাজই আমার আগে যিনি দায়িত্বে ছিলেন, তাঁর সিদ্ধান্তে হয়েছে। উন্নয়ন কমিটির সভায় যে বিষয়গুলো সঠিক মনে হয়নি, সেসব জানিয়েছি। এগুলোর দায় আমি নিতে পারি না।’
উন্নয়ন প্রকল্পের প্রতিটি কাজই আমার আগে যিনি দায়িত্বে ছিলেন, তাঁর সিদ্ধান্তে হয়েছে। উন্নয়ন কমিটির সভায় যে বিষয়গুলো সঠিক মনে হয়নি, সেসব জানিয়েছি। এগুলোর দায় আমি নিতে পারি না।অধ্যাপক হাফিজা খাতুন, উপাচার্য, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
২০১৮ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ে ২১টি নতুন অবকাঠামো নির্মাণের এ প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া হয়। এর মধ্যে রয়েছে ১২ তলাবিশিষ্ট দুটি একাডেমিক ভবন, ১০ তলাবিশিষ্ট দুটি আবাসিক হল, আটতলাবিশিষ্ট একটি প্রশাসনিক ভবন, চারতলাবিশিষ্ট একটি মিলনায়তন ভবন, তিনতলাবিশিষ্ট শিক্ষক-কর্মকর্তা ক্লাব, চারতলাবিশিষ্ট একটি কনভেনশন ভবন, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার, রাস্তা ও পুকুর খনন এবং পুকুরঘাট নির্মাণ, কেন্দ্রীয় পানিনিষ্কাশনব্যবস্থা, অ্যাম্ফিথিয়েটার, আনসার ক্যাম্প, মূল ফটক, চারতলাবিশিষ্ট ওয়ার্কশপ ও পুলিশ স্টেশন, মন্দির, ভূমি উন্নয়ন ও মাটি ভরাট এবং বৈদ্যুতিক সাবস্টেশন নির্মাণ।
প্রকল্প বাস্তবায়নের ব্যয় ধরা হয়েছিল ২৯৯ কোটি ৩৫ লাখ টাকা। এরপর জি এম আজিজুর রহমান নামের একজন অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তাকে প্রকল্প পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। একই সঙ্গে সাবেক উপাচার্য এম রোস্তম আলীকে সভাপতি ও প্রকল্প পরিচালককে সদস্যসচিব করে ১২ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়।
২০১৮ সালে শুরু হওয়া প্রকল্প শেষ করার কথা ছিল ২০২১ সালের জুনে। কিন্তু নির্ধারিত সময়ে কোনো কাজ শেষ হয়নি। ফলে চলতি বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হয়। এতে প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ৪৮০ কোটি ৬০ লাখ টাকা। অথচ বর্তমানে প্রকল্পের কাজ মাত্র ৩০ শতাংশ শেষ হয়েছে। এতে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন উপাচার্য হাফিজা খাতুন।
গত ৩০ মে কমিটির পঞ্চম সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। সভায় উপস্থিত একাধিক সদস্য জানিয়েছেন, উন্নয়ন প্রকল্পে দোতলাবিশিষ্ট আনসার ভবন নির্মাণের প্রাথমিক ব্যয় ধরা হয়েছিল ১ কোটি টাকা। পরে তা করা হয়েছে ১ কোটি ৪৬ লাখ টাকা। এরপরও ভবনটি দোতলার জায়গায় একতলা করা হয়। এ ক্ষেত্রে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কোনো অনুমোদন নেওয়া হয়নি।
এদিকে তিনতলাবিশিষ্ট শিক্ষক কর্মকর্তা ক্লাবের প্রাথমিক নির্মাণ ব্যয় ছিল ৩ কোটি ৭৩ লাখ টাকা, পরে এটি ৪ কোটি ৫৩ লাখ টাকা করা হয়। কিন্তু ভবনটি তিনতলার জায়গায় হয়েছে দোতলা। অ্যাম্ফিথিয়েটার নির্মাণের প্রাথমিক ব্যয় ৪৩ লাখ টাকা ধরা হলেও এটিতে খরচ হয়েছে ৫৮ লাখ টাকা। এরপরও মাস্টারপ্ল্যান অনুযায়ী কাজটি হয়নি। এ ছাড়া মৎস্য অধিদপ্তর থেকে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে খনন করা লেকের ঘাট নির্মাণে ব্যয় দেখানো হয়েছে ৩০ লাখ টাকা।
গত ৩০ মের সভায় প্রকল্প পরিচালক জি এম আজিজুর রহমান বলেন, দোতলা ভবন একতলা ও তিনতলা ভবন দোতলা করা হয়েছে সাবেক উপাচার্যের অনুমতি নিয়ে। মাটি পরীক্ষা ও পাইলিং ছাড়া ভবন নির্মাণ করা যাবে না বলে প্রকল্প অফিসকে অবগত করে। পরে বিষয়টি প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটিতে উপস্থাপন করা হলে ভবনের পরিধি ছোট করা হয়। নির্মাণকাজের ধীরগতি বিষয়ে তিনি বলেন, এ বিষয়ে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে বিভিন্ন সময়ে সতর্ক করে চিঠি দেওয়া হয়েছে।
এদিকে প্রকল্পের আওতায় ২০২০ সালের আগস্ট মাসে বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য ১০ কোটি টাকার বই কেনার দরপত্র আহ্বান করা হয়। অভিযোগ আছে, একটি বিশেষ মহলকে সুবিধা দিতে দরপত্রে বিভিন্ন শর্ত দেওয়া হয়।
পরে দরপত্র অনুযায়ী তৎকালীন উপাচার্য ও প্রকল্প পরিচালক গোপনে একটি প্রতিষ্ঠানকে বই কেনার কার্যাদেশ দেন। সে অনুযায়ী দুই বছর পর গত মার্চ মাসে প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম কিস্তির বই সরবরাহ করা হয়। কিন্তু এসব বই নকল ও নিম্নমানের হওয়ায় বিভিন্ন বিভাগের প্রধানেরা তা নেননি। গ্রন্থাগার কর্তৃপক্ষও তাই বই ফিরিয়ে দেয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপগ্রন্থাগারিক হাফিজুর রহমান বলেন, ‘আমাদের কাছে যেসব বই এসেছে, তা নিম্নমানের ও পাইরেটেড। ফলে বিভাগের চেয়ারম্যানদের আপত্তির কারণে এসব বই গ্রহণ করা হয়নি।’