দিনাজপুরের সুগন্ধি চাল
বেড়েছে চাহিদা–উৎপাদন, দামও বাড়ছে পাল্লা দিয়ে
দিনাজপুরে কাটারিভোগের ফলন বেশি। চাহিদা ও লাভ বেশি হওয়ায় কৃষকেরাও সুগন্ধি ধান চাষে ঝুঁকছেন।
বাঙালির উৎসব মানেই পোলাও, বিরিয়ানি কিংবা ফিরনি-পায়েস। এ জন্য দরকার সুগন্ধি চাল। বিত্তবান কিংবা নিম্নমধ্যবিত্ত—সবার বাড়িতে এ চালের দেখা মেলে। হোটেল-রেস্তোরাঁতেও এ চালের ব্যবহার বেড়েছে। দেশে এ চালের চাহিদা ও উৎপাদন দুটোই বেড়েছে। তবে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে দামও। ব্যবসায়ীরা বলছেন, মোটা-চিকন সব ধরনের চালের দাম ওঠানামা করে। তবে সুগন্ধি চালের বাজার সব সময়ের জন্যই ঊর্ধ্বমুখী।
ধানের জেলা হিসেবে দিনাজপুরের খ্যাতি অনেক পুরোনো। বোরো কিংবা আমন প্রতি মৌসুমেই ধান উৎপাদনে দেশের শীর্ষ জেলাগুলোর একটি দিনাজপুর। প্রাকৃতিক কারণে দিনাজপুরে কাটারিভোগের ফলন বেশি। চাহিদা ও লাভ বেশি হওয়ায় কৃষকেরাও সুগন্ধি ধান চাষে ঝুঁকছেন। গত এক দশকে দিনাজপুরে উৎপাদিত বাদশাভোগ, কালিজিরা, চিনিগুঁড়া, কাটারিভোগ, জিরা নাজির, পাইজাম, বাংলামতি চালের কদর এখন বিশ্বজোড়া। দিনাজপুরের কাটারিভোগ ও কালিজিরা চাল ইতিমধ্যে ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে।
এ চালের সঙ্গে জড়িয়ে আছে শত বছরের ঐতিহ্যও। কখন, কীভাবে দিনাজপুরে কাটারিভোগের উৎপাদন শুরু হয়, তা নির্দিষ্ট করে জানা যায় না। তবে কাটারিভোগ নিয়ে স্থানীয়ভাবে নানা গল্প প্রচলিত আছে। স্থানীয় বাসিন্দারা বলেন, কাটারিভোগ চাল দিয়েই দেবতাকে প্রসাদ বা ভোগ দেওয়ার রীতি আছে বলেই এর নাম হয়েছে কাটারিভোগ। দিনাজপুরের মানুষ আত্মীয়স্বজনকে উপঢৌকন হিসেবে কাটারিভোগ চাল পাঠিয়ে থাকেন।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, একসময় কৃষকেরা অন্যান্য ধানের পাশাপাশি সামান্য পরিমাণে ব্রি ধান-৩৪, জিরা কাটারি, চল্লিশাজিরা, বাদশাভোগ, কালোজিরা, জটা কাটারি, কাটারিভোগ ধানের আবাদ করতেন। ২০১২-১৩ অর্থবছর থেকে সুগন্ধি ধানের আবাদ বাড়তে থাকে। ওই বছর ৮৬ হাজার ৯৯৪ মেট্রিক টন সুগন্ধি চাল উৎপাদিত হয়। এরপর ধারাবাহিকভাবে আবাদ ও উৎপাদন বেড়েছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে ১ লাখ ২ হাজার ৪০১ হেক্টর জমিতে ২ লাখ ১২ হাজার মেট্রিক টন এবং ২০২০-২১ অর্থবছরে ১ লাখ ৫ হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে ২ লাখ ৩৫ হাজার মেট্রিক টন সুগন্ধি চাল উৎপাদন হয়েছে।
বাড়ছে চাহিদা, দাম
দিনাজপুরের বড়বন্দর এলাকায় তিন প্রজন্ম ধরে চালের ব্যবসা করছেন এ কে দাস ট্রেডার্সের মালিক অসীম কুমার দাস। এখনো হাস্কিং মিলে সনাতন পদ্ধতিতে সুগন্ধি চাল উৎপাদন করেন তিনি। খুচরা বিক্রির পাশাপাশি সম্প্রতি অনলাইনেও চালের ব্যবসা শুরু করেছেন তিনি। প্রতিদিন ৩০ মণেরও বেশি চাল বিক্রি হয় তাঁর। তাঁর দোকানে টাঙানো মূল্যতালিকা অনুযায়ী, খুচরা প্রতি কেজি বাদশাভোগ ১২০ টাকা, কালিজিরা ১১০ টাকা, চিনিগুঁড়া ১০০ টাকা, কাটারিভোগ ১০০ টাকা, সিদ্ধ কাটারি ৯৫ টাকা, সিদ্ধ জিরা নাজির ৭২ টাকা, সিদ্ধ পাইজাম ৬৮ টাকা, সিদ্ধ বাংলামতি ৭২ টাকায় বিক্রি করছেন তিনি। ১ থেকে ৫০ কেজি পর্যন্ত চাল প্যাকেটজাত করে বিক্রি করা হয়।
অসীম কুমার দাস প্রথম আলোকে বলেন, সুগন্ধি চাল শৌখিন মানুষের খাবার। দুই মাস আগেও এসব চাল কেজিপ্রতি ৫ থেকে ১০ টাকা কমে বিক্রি হয়েছে। বছরখানেক আগে সুগন্ধি চাল ৮০ থেকে ৮৫ টাকা বিক্রি হয়েছে। অবশ্য করোনাকালে অনুষ্ঠানাদি কম থাকায় বিক্রি কম ছিল। অনেক মিলমালিকের গুদামে চাল পড়ে ছিল। দাম বাড়ার কারণ হিসেবে তিনি বলেন, এ ধান বাজারে পাওয়া যায় কম। ধান শুকানোর ঝামেলা কম, আবার দীর্ঘদিন সংরক্ষণ করা যায় বলে বেশি লাভের আশায় কৃষকেরা নিজেরাই সংরক্ষণ করেন। বাজারে দাম বাড়তি হলে তখন বিক্রি করেন।
অনলাইনে চিনিগুঁড়া ও কাটারিভোগ চালের ব্যবসা করছেন হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আন্নিকা তাবাসসুম। তিনি প্রথম আলোকে বললেন, ৫ থেকে ৫০ কেজির বিভিন্ন প্যাকেট হিসেবে প্রতি মাসে গড়ে ২০ মণেরও বেশি চালের অর্ডার পান তিনি। স্থানীয় মিলমালিকদের কাছ থেকে চাল সংগ্রহ করে সামান্য লাভে বিক্রি করেন।
সদর উপজেলার ফাসিলাডাঙ্গা এলাকার কৃষক রায়হান আলী (৪৫) গত আমন মৌসুমে ৮ বিঘা জমিতে জিরা নাজির ও চিনিগুঁড়ার আবাদ করেন। তিনি জানান, প্রতি বিঘা জমিতে ধান কাটা-মাড়াই পর্যন্ত তাঁর ১৯ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। ধান পেয়েছেন ১৬ মণ। প্রতি মণ ধান বিক্রি করেছেন ১ হাজার ৭০০ টাকা। তাঁর লাভ হয়েছে ৮ হাজার ২০০ টাকা।
ছড়িয়ে পড়ছে ভেজাল
সুগন্ধি চাল ছোট দানার ও চিকন। আবার কোনোটির দানা অনেকটা গোলাকৃতির। সব জায়গায় এ ধানের চাষ হয় না। এমনকি দিনাজপুরেও শুধু সদর, চিরিরবন্দর, কাহারোল ও খানসামা উপজেলার অপেক্ষাকৃত মাঝারি উঁচু জমিতে এ ধানের চাষ হয়। কৃষি কর্মকর্তারা বলছেন, সাধারণত উঁচু বেলে-দোআঁশ মাটিতে এ ধরনের ধান চাষ হয়।
সাম্প্রতিক সময়ে চিনিগুঁড়া কিংবা কাটারিভোগ চালের মতো দেখতে বেশ কিছু চালের উৎপাদন হচ্ছে। সেসব চালে সুগন্ধিযুক্ত পাউডার মিশিয়ে বাজারজাত করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন খোদ চাল ব্যবসায়ীরা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে জেলা শিল্প ও বণিক সমিতির সাবেক নেতা ও স্থানীয় এক মিলমালিক বলেন, মেশিনে মসৃণ করে চালের আকৃতি ছোট করে পাউডার মেশানো হচ্ছে। কাজটি জেনেশুনেই করছেন কেউ কেউ। বিষয়টি দুঃখজনক। ধানের নামের সঙ্গে বাজারে চালের নামেরও অমিল। খাঁটি সুগন্ধি চাল কোনটি বুঝে ওঠা মুশকিল।