বুকভরা অভিমান নিয়ে এক মুক্তিযোদ্ধার চিরবিদায়
শেষযাত্রায় রাষ্ট্রীয় মর্যাদা চাননি অভিমানী মুক্তিযোদ্ধা ইসমাইল হোসেন। মৃত্যুর দুই দিন আগে নিজের ক্ষোভ-দুঃখের কথাগুলো লিখে রেখে গিয়েছিলেন স্বজনদের কাছে। গতকাল বৃহস্পতিবার এই বীর মুক্তিযোদ্ধা বিদায় নিলেন প্রশাসনের স্যালুট ও বিউগলের করুণ সুর ছাড়াই।
দিনাজপুর সদর উপজেলার যোগীবাড়ি গ্রামের বাসিন্দা মুক্তিযোদ্ধা ইসমাইল হোসেনের মনে ক্ষোভ, অভিমান ছিল তাঁর এক ছেলের চাকরিচ্যুতি নিয়ে। মৃত্যুর আগে তিনি লিখে গেছেন, ‘...যারা আমার ছেলেকে চাকরিচ্যুত করেছে, পেটে লাথি মেরেছে, শেষযাত্রার কফিনে তাদের সালাম, স্যালুট আমি চাই না।’
জানা গেছে, মুক্তিযোদ্ধা ইসমাইল হোসেনের দ্বিতীয় ছেলে নূর হোসেন জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে ড্রাইভার পদে দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে চাকরি করতেন। স্থানীয় সাংসদ ও হুইপ ইকবালুর রহিমের সুপারিশে ২০১৭ সালে তাঁর চাকরি হয়। নূর হোসেন সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. আরিফুল ইসলামের গাড়ি চালাতেন। সম্প্রতি ছেলেকে চাকরিচ্যুত করা হলে
ইসমাইল হোসেন মানসিকভাবে ব্যথিত হন। ৮০ বছর বয়সী এই মুক্তিযোদ্ধা দীর্ঘদিন ধরে শ্বাসকষ্টজনিত রোগে ভুগছিলেন। ২১ অক্টোবর শারীরিক অবস্থা খারাপ হলে তাঁকে দিনাজপুর এম আবদুর রহিম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করেন ছেলেরা। সেখানেই তিনি আক্ষেপ করে কথাগুলো বলেন। এ সময় ইসমাইল হোসেন তাঁর কথাগুলো ভাইয়ের ছেলে এ এস এম জাকারিয়াকে চিঠি আকারে লিখতে বলেন। এই চিঠি হুইপ ইকবালুর রহিমের কাছে পৌঁছে দেওয়ারও নির্দেশনা দেন তিনি।
চিঠিতে ইসমাইল হোসেন অভিযোগ করেন, তাঁর ছেলে নূর হোসেনকে দিয়ে ভূমি কমিশনার বাসার রান্নাসহ বিভিন্ন কাজ করাতেন। সামান্য কারণেই কমিশনার ছেলের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করতেন। অফিসে যেতে দেরি করায় এবং বাসার শৌচাগার পরিষ্কার করতে রাজি না হওয়ায় গত আগস্টে তাঁর কাছ থেকে গাড়ির চাবি নিয়ে নেওয়া হয়। তিনি ঈদগাহ বস্তি এলাকায় সরকারি একটি পরিত্যক্ত বাসায় থাকতেন। পরে সেখান থেকেও নূর হোসেনকে বের করে দেওয়া হয়। চাকরির পর বাসা থেকেও উচ্ছেদ হয়ে স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে বেশ কষ্টে দিন যাপন করছেন নূর হোসেন।
দুই পৃষ্ঠার চিঠিতে মুক্তিযোদ্ধা ইসমাইল হোসেন প্রশ্ন তোলেন, ‘প্রশাসন কোন লাভ এবং লোভের আশায় ঠুনকো কারণ দেখিয়ে আমার ছেলেকে চাকরি ও বাস্তুচ্যুত করল? ছেলে চাকরিচ্যুত হওয়ায় আমি শারীরিক ও মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছি। এই অবস্থায় যদি আমার মৃত্যু হয়, তাহলে আমাকে যেন রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন করা না হয়। কারণ এসি ল্যান্ড, ইউএনও, এডিসি, ডিসি যাঁরা আমার ছেলেকে চাকরিচ্যুত করেছে, পেটে লাথি মেরেছে, তাদের সালাম-স্যালুট আমার শেষযাত্রার কফিনে আমি চাই না।’
মুক্তিযোদ্ধা ইসমাইল হোসেন গত বুধবার সকালে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। ম্যাজিস্ট্রেট মহসীন উদ্দিনের নেতৃত্বে স্থানীয় প্রশাসনের কর্মকর্তা ও পুলিশ সদস্যরা তাঁকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন করতে যান। কিন্তু তাঁর ছেলেরা বাবার মৃত্যুর আগের অছিয়তের কথা বলে তাঁদের ফিরিয়ে দেন। গতকাল বেলা সাড়ে ১১টায় ইসমাইল হোসেনকে যোগীবাড়ি গ্রামের পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়।
দিনাজপুরের জেলা প্রশাসক মো. মাহমুদুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘একজন মুক্তিযোদ্ধা দেশের সর্বোচ্চ সম্মানীয় ব্যক্তি। তাঁর মৃত্যুর খবর পাওয়ামাত্র সেখানে আমরা লোকজন পাঠিয়েছি। কিন্তু তাঁর পরিবার গার্ড অব অনার গ্রহণ করেনি।’
চিঠির বিষয়ে জেলা প্রশাসক বলেন, ‘আমি বিষয়টি অবগত ছিলাম না। নূর হোসেন যে মুক্তিযোদ্ধার সন্তান, সেটাও জানতাম না। চাকরির প্রতি তাঁর অবহেলার কথা বেশ কিছুদিন আগে আমাকে এসি ল্যান্ড জানিয়েছিলেন। বিষয়টি খতিয়ে দেখে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’
অবশ্য দিনাজপুর সদর উপজেলা সহকারী কমিশনার মো. আরিফুল ইসলাম দাবি করেন, ‘নূর হোসেন মাদকাসক্ত ছিলেন। তিনি যখন গাড়ি চালাতেন, তখন তিনি নিরাপদ বোধ করতেন না। গত পূজার সময়ও কয়েক দিন অনুপস্থিত ছিলেন। তাই তাঁকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। চিঠিতে তাঁর বিরুদ্ধে আনা অভিযোগকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে মন্তব্য করেন সহকারী কমিশনার।
তবে হুইপ ইকবালুর রহিম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি একজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তানকে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছিলাম। কী কারণে তার চাকরি গেল, একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা তাঁর প্রাপ্য সম্মান না নিয়ে বিদায় নিলেন, তা তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’