বিদ্যুৎকেন্দ্র করতে মেঘনা ভরাট
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন কোম্পানি লিমিটেডের (এপিএসসিএল) বিরুদ্ধে মেঘনা নদীর তীরভূমি দখল করে বালু ভরাটের অভিযোগ উঠেছে। এতে নদীর গতিপথ পরিবর্তিত হবে। পাশাপাশি আশুগঞ্জ নৌবন্দর এলাকায় ব্যাপক নদীভাঙন দেখা দেবে।
এপিএসসিএলের দাবি, তারা নিজস্ব জায়গাই ভরাট করছে। তবে বিআইডব্লিউটিএ এবং পাউবোর কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, তাঁদের কর্মকর্তারা জায়গাটি পরিদর্শন করেছেন। ভরাট করা জায়গা নদীর বলেই তাঁদের কাছে প্রতীয়মান হয়েছে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ উপজেলার সোহাগপুর গ্রামের বাসিন্দা নাসির মিয়া গত ১৯ জানুয়ারি নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান, সচিব ও আশুগঞ্জ-ভৈরব নদীবন্দরের উপপরিচালকের কাছে দেওয়া লিখিত অভিযোগে নদীপাড়ের জমি দখলের এই অভিযোগ করেন। এতে মেঘনা নদীর ‘গতিরোধ, পরিবেশ বিনষ্ট ও নদীভাঙন ঠেকাতে’ ভরাট বন্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার আরজি জানানো হয়।
অভিযোগকারী নাসির মিয়া কৃষক ও ব্যবসায়ী। আশুগঞ্জ বন্দরে তাঁর ধান–চালের ব্যবসা আছে। এ ছাড়া তিনি উপজেলা আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক কমিটির সদস্য। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘বালু ভরাট অংশের পশ্চিম-উত্তর পাশ দিয়ে সোহাগপুর গ্রামের দিকে বড় খাল গেছে৷ এই খাল দিয়ে একসময় মানুষ জেলায় গেছে। আর বর্তমানে দেশের সিলেট, জামালপুর, ময়মনসিংহ, গোপালগঞ্জ, বরিশালসহ বিভিন্ন জেলা থেকে বন্দরে আসা ধান–চালের নৌকা ওই খালে রাখা হয়। কিন্তু তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র কর্তৃপক্ষ মেঘনার জায়গা ভরাটের পর ওই খালও দখলে নিয়েছে। আমি আরেকটি অভিযোগ দিব।’
নাসির মিয়ার লিখিত অভিযোগে বলা হয়, সরকারি মালিকানাধীন এপিএসসিএল কর্তৃপক্ষ সোহাগপুর ও বাহাদুরপুর মৌজায় মেঘনা নদীর পাশের প্রায় ৩০০ একর কৃষিজমি অধিগ্রহণের চেষ্টা করে। কিন্তু স্থানীয় জনগণের প্রতিরোধের কারণে তারা জমি অধিগ্রহণ করতে পারেনি। এখন এপিএসসিএল কর্তৃপক্ষ বিকল্প হিসেবে মেঘনা নদীর পাড় ও নদীর ভেতরের শত শত একর জায়গা অবৈধভাবে ভরাট করছে। এতে নদীর গতিপথ পরিবর্তিত হবে। পাশাপাশি আশুগঞ্জ নৌবন্দর এলাকায় ব্যাপক নদীভাঙন দেখা দেবে। মেঘনা নদীতে জেগে ওঠা চরসোনারামপুর গ্রামটি একেবারে নদীতে বিলীন হয়ে যাবে। ওই গ্রামে প্রায় দুই হাজার জেলে পরিবারের বসবাস। তাঁদের বাড়িঘর-সহায়-সম্পত্তিসহ আশুগঞ্জ এলাকার একমাত্র শ্মশান এবং চরে অবস্থিত ২৩০ কেভি ক্ষমতাসম্পন্ন আশুগঞ্জ-সিরাজগঞ্জ জাতীয় গ্রিডের বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইনের টাওয়ার নদীতে বিলীন হবে।
স্থানীয় লোকজন বলেন, তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র কর্তৃপক্ষ কৌশলে কেন্দ্রের রেস্টহাউসের পেছনে নিজেদের সীমানাপ্রাচীরের বাইরে মেঘনা নদীর পারে এক থেকে দেড় কিলোমিটার এলাকাজুড়ে নতুন করে প্রতিরক্ষাদেয়াল নির্মাণ করেছে। মেঘনা নদী থেকেই বালু উত্তোলন করে নতুন সীমানাপ্রাচীরের ভেতরে ফেলে পাড় ভরাট করে জায়গা দখলে নিয়েছে এপিএসসিএল কর্তৃপক্ষ। স্থানীয় একজন ঠিকাদার সেখানে সাড়ে সাত কোটি টাকার বালু ভরাটের কাজ পেয়েছেন। মেঘনার পাড়ে এপিএসসিএলের কোনো জায়গা নেই।
দুর্গাপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান জিয়াউল করিম খান বলেন, মেঘনার পাড়ে সীমানাপ্রাচীর দিয়ে রেস্টহাউস নির্মাণ করেছে এপিএসসিএল। সীমানাপ্রাচীরের পরে তাদের বড়জোর ১৫-২০ ফুট জায়গা থাকতে পারে।
পরিবেশবাদী সংগঠন নোঙরের আশুগঞ্জ উপজেলার আহ্বায়ক ইকরামুল ইসলাম চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, মেঘনার পাড় দখল করে ভরাট করা হয়েছে। এর প্রভাবে নদীর গতিপথ পরিবর্তিত হতে পারে। পাশাপাশি উপজেলার সোহাগপুর এলাকার নদীপারের ফসলি জমি, নদীর মাঝে জেগে ওঠা চরসোনারামপুর গ্রাম, সেখানে থাকা কয়েক জেলার বিদ্যুৎ সঞ্চালন টাওয়ার ও আশুগঞ্জ বন্দর ব্যাপকভাবে ভাঙনের হুমকির মুখে পড়বে।
সম্প্রতি সরেজমিন দেখা যায়, আশুগঞ্জ বন্দর থেকে প্রায় দুই কিলোমিটার উত্তর দিকে এপিএসসিএলের রেস্টহাউস। এর পেছনে সীমানাপ্রাচীর থেকে নদীর দিকে ১৫০ থেকে ২০০ ফুট প্রস্থের ও দুই থেকে আড়াই হাজার ফুট দৈর্ঘ্যের নতুন করে দেয়াল নির্মাণ করে বালু ভরাট করা হয়েছে। ভরাটের কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে।
সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তারাও বলছেন, বিদ্যুৎ কোম্পানির ভরাট করা জায়গা নদীর বলেই তাঁদের কাছে মনে হয়েছে। এ বিষয়ে বিআইডব্লিউটিএর আশুগঞ্জ-ভৈরব নদীবন্দরের কর্মকর্তা (উপপরিচালক) শহীদ উল্যাহ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের পরিদর্শক মো. জসিম জায়গাটি পরিদর্শন করেছেন। ভরাট করা জায়গাটি নদীর বলে তাঁর কাছে প্রতীয়মান হয়েছে। এ ব্যাপারে নদী রক্ষা কমিশন একটি কমিটি গঠন করেছে।’
আর ব্রাহ্মণবাড়িয়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী প্রকৌশলী রঞ্জন কুমার বলেন, তাঁদের লোকজন জায়গাটি পরিদর্শন করেছেন। আপাতদৃষ্টে বালু দিয়ে ভরাট করা জায়গা নদী ও নদীর প্লাবনভূমির মধ্যে রয়েছে বলে মনে হচ্ছে। যাচাই-বাছাই শেষে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে এপিএসসিএল কর্তৃপক্ষকে চিঠি লিখবেন তিনি।
এপিএসসিএল সূত্র জানায়, ভারী যন্ত্রপাতি পরিবহন ও গ্যাসপ্রাপ্তির সহজলভ্যতার বিবেচনায় ১৯৬৬-৬৭ সালে মেঘনা নদীর তীরে আশুগঞ্জ তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করা হয়। তখন উপজেলার সোহাগপুর, সোনারামপুর, বাহাদুরপুর মৌজার ৩১১ একর ভূমি অধিগ্রহণ করা হয়। ২০০৩ সালে এই বিদ্যুৎকেন্দ্র কোম্পানিতে রূপান্তরিত হয়। কোম্পানি কর্তৃপক্ষের দাবি, পুরোনো সীমানাপ্রাচীরের বাইরে মেঘনা নদীর তীরে কোম্পানির নিজস্ব প্রায় তিন একরের বেশি অব্যবহৃত ভূমি আছে। সেখানে প্রতিরক্ষাদেয়াল নির্মাণ করে ভরাট করা হচ্ছে।
এ বিষয়ে এপিএসসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ এফ এম সাজ্জাদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, স্বাধীনতার আগে জায়গাটি অধিগ্রহণ করা হয়। সেটি পরিত্যক্ত অবস্থায় ছিল। ভরাট করা ওই জায়গায় নতুন করে বহুতল ভবন ও বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করা হবে। এলাকাবাসীর অভিযোগের জবাবে তিনি বলেন, ‘মানুষ তো অভিযোগ দিতে পারে। কিন্তু তারা কোনো প্রমাণ তো দেখাতে পারবে না।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে আশুগঞ্জ উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) ফিরোজা পারভীন বলেন, এ নিয়ে তদন্ত চলছে। আগামী সপ্তাহে নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যানের আশুগঞ্জে আসার সম্ভাবনা রয়েছে। খুব শিগগির জায়গাটি পরিদর্শন করে প্রতিবেদন দেওয়া হবে।