নারায়ণগঞ্জের চার নদী
বাল্কহেডে লস্করই সুকানি
লস্করের কাজ হলো নোঙর ফেলা। তবে বাল্কহেডের ক্ষেত্রে যথাযথ প্রশিক্ষণ ছাড়া লস্করই একসময় সুকানি হয়ে ওঠেন। পরিচালনা করেন নৌযান।
মেঘনা, বুড়িগঙ্গা, ধলেশ্বরীতে চলে প্রায় দুই হাজার বাল্কহেড।
নারায়ণগঞ্জে ৫০ শতাংশ বাল্কহেডের নিবন্ধন নেই।
বিআইডব্লিউটিএ ও নৌ পুলিশকে মাসোহারা দিতে হয় ৩-১০ হাজার টাকা।
নারায়ণগঞ্জে চার নদী মেঘনা, বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা ও ধলেশ্বরীতে চার হাজারের বেশি বাল্কহেড (বালুসহ বিভিন্ন মালামাল বহনকারী ইঞ্জিনচালিত ট্রলার) চলাচল করছে। এর অর্ধেকের বেশি বাল্কহেডের নিবন্ধন, প্রশিক্ষিত চালক ও সুকানি নেই। তাঁরা সিগন্যাল না বোঝায় ঘটে দুর্ঘটনা।
১৫ বছর আগে একটি বাল্কহেডে লস্কর (নোঙর ফেলেন যিনি) হিসেবে যোগ দেন মো. সেলিম। এ কাজ করার সাত বছর পর সুকানি (মাস্টারের সহযোগী হিসেবে নৌযান পরিচালনা করেন) হন। প্রশিক্ষণ না থাকলেও তিনি এখন চালক (ইঞ্জিন নিয়ন্ত্রণ করেন)। সেলিম বলেন, তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ ও সনদ নেই। সিগন্যাল বুঝতে না পারার কারণে বাল্কহেড চালাতে গিয়ে পাঁচ থেকে সাতবার তিনি দুর্ঘটনার শিকার হয়েছেন।
একটি বাল্কহেডের সুকানি তৈয়ব আলী বলেন, ২০০৭ সালে রাজধানীর দিয়াবাড়ীতে তাঁর ভুলের কারণে দুই বাল্কহেডের মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়।
বাংলাদেশ নৌযান কর্মচারী শ্রমিক ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক সবুজ সিকদার বলেন, প্রশিক্ষণ না থাকায় চালকেরা জাহাজের নেভিগেশন বাতি ও সিগন্যাল বুঝতে না পারার কারণে দুর্ঘটনা ঘটছে। প্রতি মাসে ছোটখাটো ৩০ থেকে ৪০টি দুর্ঘটনা ঘটে।
বাল্কহেড শ্রমিক ইউনিয়নের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শীতলক্ষ্যায় প্রতিদিন গড়ে ৫০০ বাল্কহেড চলাচল করে। মেঘনা, বুড়িগঙ্গা, ধলেশ্বরী নদীতে দুই হাজার বাল্কহেড চলে। কয়লা, পাথর, সিমেন্টসহ বিভিন্ন মালামাল পরিবহন করে দেড় হাজার বাল্কহেড। সারা দেশে ১০ হাজারের বেশি বালুবাহী বাল্কহেড আছে। এগুলোর কোনোটি ৩ থেকে ৪০ হাজার ঘনফুট ধারণক্ষমতা সম্পন্ন। এসব বাল্কহেডে করে চাঁদপুরের হরিণাসহ বিভিন্ন বালুমহাল থেকে উত্তোলন করা বালু নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ, কাঞ্চন, বুড়িগঙ্গা নদী দিয়ে আশুলিয়া, টঙ্গী, গাবতলীতে আবাসন কোম্পানি ও গদিঘরে সরবরাহ করা হয়।
নৌযানগুলোতে নেই প্রশিক্ষিত মাস্টার, চালক, সুকানি, গ্রিজার (চালকের সহকারী), নেই নেভিগেশন বাতি। অদক্ষ চালক দিয়ে নৌযান চালানোর কারণে প্রায়ই নদীতে দুর্ঘটনা ঘটে। গত বছরের ১৫ আগস্ট নবীগঞ্জ ঘাটে শীতলক্ষ্যা নদীতে বেপরোয়া বাল্কহেড ধাক্কা দিলে অল্পের জন্য রক্ষা পায় একটি ফেরি। তবে ফেরির ক্ষতি হয়। বাল্কহেডটি একজন লস্কর চালাচ্ছিলেন। ৫ মার্চ নারায়ণগঞ্জের সেন্ট্রাল খেয়াঘাটে বাল্কহেডের ধাক্কায় দুটি নৌকা ডুবে যায়, এতে এক কলেজছাত্রীর মৃত্যু হয়। নৌ পুলিশ অভিযুক্ত চালকসহ বাল্কহেডটি আটক করে।
চলছে মাসোহারা দিয়ে বিআইডব্লিউটিএ জানিয়েছে, নারায়ণগঞ্জে ৫০ শতাংশ বাল্কহেডের নিবন্ধন নেই। আর বাল্কহেড পরিচালনাকারীদের অভিযোগ আছে, বিআইডব্লিউটিএ ও নৌ পুলিশকে মাসোহারা দিয়ে অবাধে নৌযানগুলো চলছে।
নিবন্ধন না থাকায় কোনো বাল্কহেড দুর্ঘটনা ঘটিয়ে পালিয়ে গেলে, তা শনাক্ত করা কঠিন হয়ে পড়ে। বিআইডব্লিউটিএর নারায়ণগঞ্জ কার্যালয়ের উপপরিচালক (নৌ নিরাপত্তা ও ট্রাফিক) বাবু লাল বৈদ্য প্রথম আলোকে বলেন, এক বছরে অবৈধ নৌযানের বিরুদ্ধে অর্ধশতাধিক মামলা দেওয়া হয়েছে। তবে তিনি দাবি করেছেন, কোনো মাসোহারা আদায় করা হয় না।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক বাল্কহেডের মালিক বলেন, প্রতি মাসে বিআইডব্লিউটিএ ও নৌ পুলিশকে ৩–১০ হাজার টাকা মাসোহারা দিয়ে বাল্কহেড পরিচালনা করছেন। নকশা নিয়ে জটিলতা, হয়রানি ও বড় অঙ্কের টাকা উৎকোচ দাবি করায় অনুমোদন বা নিবন্ধন নিতে আগ্রহী হননি।
এ বিষয়ে নারায়ণগঞ্জ সদর নৌ পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মনিরুজ্জামান মাসোহারায় অবৈধ বাল্কহেড চলাচলের অভিযোগ অস্বীকার করেন। তবে তিনি বলেন, নৌ আইনের ২৮০ ধারায় বেপরোয়া চলাচলের অভিযোগে অবৈধ নৌযানের বিরুদ্ধে মামলা ও জরিমানা করা হয়।