বাবা–ছেলের বিরোধ ‘মেটাতে’ হেলিকপ্টার, গাড়িবহর নিয়ে এমন মহড়া!
বাবা-ছেলের পারিবারিক বিরোধ। নানা টানাপোড়েনের পর থানায় বসে সব মীমাংসাও হয়। কিন্তু হঠাৎ আজ শনিবার সেই ‘বিরোধ মেটাতে’ এলাকায় হাজির বিশাল গাড়িবহর, এল হেলিকপ্টার। এসব বাহনে চেপে আসা লোকজন পরিচয় দিলেন তাঁরা ‘মানবাধিকার কর্মী ও সাংবাদিক’।
এমন এলাহি কাণ্ডে এলাকায় হইচই পড়ে যায়। জড়ো হন আশপাশের উৎসুক মানুষ। কথিত ‘মানবাধিকারকর্মী ও সাংবাদিকদের’ খবর পেয়ে ছুটে আসেন এলাকার বিশিষ্টজনেরাও। শেষ পর্যন্ত স্থানীয়দের তোপের মুখে ফিরে যান তাঁরা। ঘটনাটি ঘটেছে চুয়াডাঙ্গার জীবননগর উপজেলার আন্দুলবাড়িয়া বাজারে।
তদন্তের নামে এই ‘শোডাউন’কে ভালোভাবে নেননি এলাকাবাসী। চুয়াডাঙ্গায় কর্মরত সাংবাদিক, আইনজীবী ও সাধারণ মানুষের তোপের মুখে পড়ে শেষ পর্যন্ত দ্রুত ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন। বিষয়টি শনিবার আন্দুলবাড়িয়া ও আশপাশের এলাকায় প্রধান আলোচ্য বিষয়ে পরিণত হয়।
স্থানীয়দের কাছে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, স্থানীয় ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান লতিফ ট্রেডার্সের মালিক আবদুল লতিফ বিশ্বাস ও তাঁর ছেলে মোস্তফা তাজওয়ারের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে পারিবারিক বিরোধ চলছে। সম্প্রতি টানাপোড়েন বাড়তে থাকে। গত ১১ অক্টোবর জীবননগর থানায় বসে পুলিশ প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি, রাজনৈতিক ও এলাকার মুরব্বিদের উপস্থিতিতে বিরোধ নিষ্পত্তি হয়।
আবদুল লতিফ বিশ্বাস বলেন, থানায় বসে নিষ্পত্তির পর সবকিছু স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু কয়েক দিন ধরে আইন সহায়তা কেন্দ্র ফাউন্ডেশনের পরিচয়ে বেশ কিছু লোক বাবা-ছেলের বিরোধের খবরকে পুঁজি করে ফায়দা লোটার চেষ্টা করেন। ফোন করে তাঁকে বিভিন্নভাবে হুমকি-ধমকিও দেওয়া হয়।
শনিবার বেলা সাড়ে ১১টায় সরেজমিনে দেখা যায় আন্দুলবাড়িয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয় মাঠের চারদিকে উৎসুক মানুষের ভিড়। উপস্থিত লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এই মাঠে প্রথমবারের মতো হেলিকপ্টার নামছে, তাই তাঁরা দেখতে এসেছেন।
দুপুর ১২টার দিকে সাতটি গাড়ির বহর বিদ্যালয় মাঠে প্রবেশ করে। পাঁচটি গাড়ির সামনে বিশাল ব্যানারে বিভিন্ন টিভি চ্যানেলের নাম লেখা ছিল। একটি গাড়ির সামনে লেখা ছিল ‘সাংবাদিক টিম’, আরেকটিতে ছিল জাতিসংঘের মনোগ্রাম-সংবলিত ব্যানার। এসব গাড়ির প্রায় ৩০ জন যাত্রী ‘দৈনিক প্রাণের বাংলাদেশ’ পত্রিকা ও আসকের পরিচয়পত্র বহন করছিল।
চারটি প্রতিষ্ঠিত টিভি চ্যানেলের ব্যানার ব্যবহারের বিষয়টি জানাজানি হলে চুয়াডাঙ্গা প্রেসক্লাবের সভাপতি সরদার আল আমিন ও সাধারণ সম্পাদক রাজীব হাসানের নেতৃত্বে গণমাধ্যমকর্মীরা সেখানে যান। তাঁরা ওই সব টিভি চ্যানেলের কোন কোন সাংবাদিক এসেছেন জানতে চান। সাংবাদিক নেতাদের প্রশ্নে কথিত মানবাধিকারকর্মী ও সাংবাদিকেরা ভড়কে যান। একপর্যায়ে তাঁরা টিভি চ্যানেলগুলোর ব্যানার খুলে ফেলেন ও ভুল স্বীকার করেন।
দুপুর ১২টার পরপরই হেলিকপ্টারে উড়ে এসে বিদ্যালয় মাঠে নামেন চারজন। দলনেতা লোকমান হোসেন সাঈদী নিজেকে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থার অধীন আইন সহায়তা কেন্দ্র ফাউন্ডেশনের ঢাকা বিভাগীয় প্রধান বলে পরিচয় দেন। বাকি তিনজনের মধ্যে কে এম আবদুল মোমেন সিরাজী নিজেকে বিটিভি ও বিটিভি ওয়ার্ল্ডের উপস্থাপক, মাসুম বিল্লাহ অধীন আইন সহায়তা কেন্দ্র ফাউন্ডেশনের সহকারী প্রধান ও আলতাফ হোসেন অতিরিক্ত বিভাগীয় প্রধান হিসেবে পরিচয় দেন।
পারিবারিক বিরোধ নিষ্পত্তিতে হেলিকপ্টারে উড়ে আসা ও গাড়ির বিশাল বহর নিয়ে শোডাউনের খরচ কে দিয়েছে, এমন প্রশ্ন করলে লোকমান হোসেন কখনো বলেন তিনি নিজে খরচ বহন করছেন, আবার পরক্ষণেই জানান, সংগঠনের সদস্যরা বহন করেছেন। আর কোনো জেলায় অতীতে এভাবে শোডাউন করে গিয়েছেন কি না বা এভাবে স্বল্প সময়ে পারিবারিক সমস্যা নিষ্পত্তির কোনো উদাহরণ আছে কি, জানতে চাইলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা উত্তর দেননি।
ঢাকা থেকে আসা ‘মানবাধিকারকর্মী ও সাংবাদিকদের’ দুপুরের পর আবদুল লতিফ বিশ্বাসের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে দ্বিতীয় দফায় স্থানীয় সাংবাদিক ও আইনজীবীদের মুখোমুখি হতে হয়। এ সময় জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি আলমগীর হোসেন, আন্দুলবাড়িয়া ইউপি চেয়ারম্যান শফিকুল আলম, সাংবাদিক নেতা সরদার আল আমিন ও রাজীব হাসান উপস্থিত ছিলেন। এ সময় ঢাকা থেকে আসা কথিত প্রতিনিধিদলের সদস্যরা স্বীকার করেন, এভাবে আসা ঠিক হয়নি। সমস্যাটি স্থানীয়ভাবে সমাধানের অনুরোধ করে ফিরে যান সবাই।
আবদুল লতিফ বিশ্বাসের ছেলে মোস্তফা তাজওয়ার এ বিষয়ে বলেন, তাঁর বাবা ২১ বছর আগে দ্বিতীয় বিয়ে করেন। এরপর থেকে তাঁদের নানাভাবে বঞ্চিত করে আসছেন। যে কারণে তিনি সহায়তার জন্য ‘অধীন আইন সহায়তা কেন্দ্র ফাউন্ডেশনে’ দরখাস্ত করেছিলেন। কিন্তু ইতিমধ্যে থানায় বসে সমাধান হয়ে যায়। বিশাল বহরের খরচের বিষয়ে জানতে চাইলে কোনো মন্তব্য করেননি মোস্তফা তাজওয়ার।