‘বাজান আমার জাপানে ছিল, ভালোই ছিল। কেন দেশে আনলাম আমি। আমিই মাইরা ফালাইলাম বাবারে আমার।’ ছেলেকে হারিয়ে সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের করিডরে এভাবে বিলাপ করে কাঁদছিলেন বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. আরিফুজ্জামানের (৩৫) মা পারভিন বেগম।
এ সময় স্বজনেরা তাঁকে নানাভাবে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছিলেন। বুক চাপড়ে পারভিন বেগম বলতে থাকেন, ‘আমার পোলারে আমি বুকে কইরা পালছি। আমার বাজানরে আমি কী করলাম!’
রোববার সকালে সাভারের বলিয়ারপুরে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন মো. আরিফুজ্জামানসহ চারজন। আরিফুজ্জামান জামালপুরের মাদারগঞ্জের গোনারিতলা গ্রামের এম এ রউফের ছেলে।
একই দুর্ঘটনায় অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী পূজা সরকারকে (২৮) হারিয়েছেন চিকিৎসক তন্ময় মজুমদার। ওই হাসপাতালের করিডরে নির্বাক বসে ছিলেন তিনি। পাশেই স্বজনেরা আহাজারি করে কাঁদছিলেন। বন্ধুরা তন্ময়কে নানাভাবে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছিলেন। কেউ কেউ আবার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে গিয়ে নিজেই কেঁদে ফেলেন। বিকেল চারটার দিকে এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে এমন হৃদয়বিদারক দৃশ্যের দেখা মেলে।
এদিন সকাল নয়টার দিকে ঢাকার সাভারের বলিয়ারপুরে দুটি বাস ও ট্রাকের সংঘর্ষ হয়। এতে ৪ জন নিহত ও ১৫-২০ জন আহত হন। নিহত অপর দুজন হলেন বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের প্রকৌশলী মো. কাওছার আহম্মেদ (৩০) ও কমিশনের স্টাফ বাসের চালক রাজীব হোসেন। কাওছার গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জের পৌনতাই গ্রামের সিকান্দার আলীর ছেলে এবং রাজীব টাঙ্গাইলের নাগরপুরের পচা সারুটিয়া গ্রামের মোক্তার হোসেনের ছেলে।
স্বজনেরা জানিয়েছেন, ভালোবেসে দেড় বছর আগে সংসার শুরু করেন তন্ময়-পূজা দম্পতি। ভালোই কাটছিল তাঁদের দিন। সম্প্রতি বদলি হয়ে মানিকগঞ্জের কর্নেল মালেক মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে দায়িত্বপালন করছিলেন তন্ময় মজুমদার। পূজা সরকার পরিবারের সঙ্গে থাকতেন ঢাকার টিকাটুলির ২৪ নং হাটখোলা রোডে। বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করতেন পূজা।
নিহত পূজার কাকা বিমল সরকার প্রথম আলোকে বলেন, ‘মাত্র দেড় বছর হলো ওরা বিয়ে করেছে। সব সময় হাসিখুশিতে মেতে থাকত ওরা। পূজাকে আমরা হারিয়ে ফেললাম। তন্ময় সব হারিয়ে দিশাহারা।’
এটিকে হত্যাকাণ্ড বলে উল্লেখ করেন তন্ময়ের বাল্যবন্ধু চিকিৎসক পারভেজ শেখ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিভিন্ন সময়ে আমরা দেখি, অপরাধীদের অপরাধগুলো আইনের মারপ্যাঁচে ছোট করে তুলে ধরা হয়। দুর্ঘটনা বলে দায় এড়িয়ে যাওয়া হয়। এসব হত্যাকাণ্ডের বিচার হতে হবে দৃষ্টান্তমূলক।’
প্রত্যক্ষদর্শী ব্যক্তিরা জানান, সকাল ৯টার দিকে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের সাভারের বলিয়ারপুর এলাকায় কুষ্টিয়া থেকে একটি গরুবোঝাই ট্রাক ও সেইফ লাইন পরিবহনের একটি বাস ঢাকার দিকে যাচ্ছিল। বাসটি চলন্ত অবস্থায় প্রথমে বাঁ পাশে দাঁড়িয়ে থাকা একটি বাসকে ধাক্কা দিয়ে ডান পাশে থাকা গরুবোঝাই ট্রাকটিকে সামনের দিকে ধাক্কা দিয়ে সড়ক বিভাজকের ওপর দিয়ে মহাসড়কের আরিচামুখী লেনে চলে আসে। পাশে জায়গা না থাকায় ট্রাকটিও সড়ক বিভাজকের ওপর দিয়ে আরিচামুখী লেনে ঢুকে পড়ে। এ সময় আরিচামুখী লেনে বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের একটি স্টাফ বাসের সামনের দিকে সজোরে ধাক্কা দেয় সেইফ লাইনের বাসটি। প্রত্যক্ষদর্শী ব্যক্তিরা দ্রুত ঘটনাস্থলে গিয়ে আহত ব্যক্তিদের উদ্ধার করে সাভারের বিভিন্ন হাসপাতালে পাঠান।
আমিনবাজার ট্রাফিক পুলিশের পরিদর্শক মো. রবিউল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হাইওয়ে পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসকে বিষয়টি জানানো হয়। পরে সব ইউনিটের সমন্বয়ে উদ্ধার অভিযান চালানো হয়।
সাভার হাইওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আতিকুর রহমান বলেন, অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের অনুমতি নিয়ে ময়নাতদন্ত ছাড়াই লাশ পরিবারের সদস্যদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। এ ঘটনায় মামলার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন।
এদিকে এ দুর্ঘটনায় শোক প্রকাশ করেছেন এবং সমবেদনা জানিয়েছেন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমন্ত্রী স্থপতি ইয়াফেস ওসমান। তিনি বলেন, ‘কত মানুষের করের টাকা, কষ্টের টাকায় একেকজন বিজ্ঞানী তৈরি হয়। যেসব কর্মকর্তা মারা গেছেন, তাঁদের একজন তো খুবই সিনিয়র, বাকি দুজন মিড লেভেলের। তাঁদের কোনো পরিপূরক আমাদের কাছে নেই। এই দুঃখের কথা কাকে বলব!’
দুপুরে হতাহত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দেখতে গিয়ে সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সাংবাদিকদের তিনি এসব কথা বলেন। এ সময় তাঁর সঙ্গে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় এবং পরমাণু শক্তি কমিশনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।