প্রার্থী 'মেসেজের' অপেক্ষায়, প্রতিমন্ত্রী বললেন 'দিয়েছি'
নাটোরের সিংড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলকের একটি ‘মেসেজের’ অপেক্ষায় আছেন ওই উপজেলায় আওয়ামী লীগ মনোনীত উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থী শফিকুল ইসলাম। তাঁর ধারণা, প্রতিমন্ত্রীর মোবাইল থেকে একটি মেসেজ এলেই দলের নেতা-কর্মীরা তাঁর পক্ষে কাজ করবেন। নৌকার কর্মীদের ওপর হামলা এবং এলাকায় নাশকতা বন্ধ হয়ে যাবে।
তবে প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক প্রথম আলোকে বলেন, তিনি অনেক আগেই এ বিষয়ে ‘মেসেজ’ দিয়েছেন। সবাইকে দলের প্রার্থীর পক্ষে কাজ করতে বলেছেন।
কাল রোববার এ উপজেলায় নির্বাচন। এখানে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে নৌকা নিয়ে মাঠে আছেন সেখানকার পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি শফিকুল ইসলাম। তিনি ওই উপজেলার বর্তমান চেয়ারম্যানও। বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে ভোটযুদ্ধে আছেন আদেশ আলী সরদার। ছাত্রদল-যুবদলের সাবেক নেতা এবং উপজেলা বিএনপির দপ্তর সম্পাদক ছিলেন তিনি। ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে স্থানীয় সাংসদ, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলকের হাত ধরে আওয়ামী লীগে যোগ দেন তিনি।
উপজেলা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে গত কয়েক সপ্তাহ সিংড়ায় ব্যাপক উত্তেজনা বিরাজ করছে। গত শুক্রবার গভীর রাতে সুকাশ ইউনিয়নের বেলোয়া গ্রামে নৌকার প্রার্থীর নির্বাচনী কার্যালয় পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। তার আগের রাতে শেরকোল ইউনিয়নের তেলিগ্রামে নৌকার প্রায় এক হাজার পোস্টার খুলে নদীতে ফেলে দেওয়া হয়।
বেলোয়া গ্রামের অন্তত ১০ জন ভোটার জানান, আওয়ামী লীগের প্রার্থী শফিকুল ইসলাম বেলোয়া উচ্চবিদ্যালয়ের মাঠের পাশে একটি টিনের ঘরে তাঁর নির্বাচনী কার্যালয় স্থাপন করেছিলেন। শুক্রবার গভীর রাতে দুর্বৃত্তরা কার্যালয়টিতে আগুন লাগিয়ে দেয়। এতে ঘরে থাকা সহস্রাধিক পোস্টার, টেবিল, চেয়ার, কাঠের নৌকা, দরজাসহ পুরো ঘরটি পুড়ে যায়।
আজ শনিবার সেখানে গেলে নৌকার এক কর্মী শাজাহান আলী প্রামাণিক বলেন, ‘কয়েক দিন ধরে বিদ্রোহী প্রার্থীর কর্মীরা নির্বাচনী কার্যালয়টি বন্ধ করার হুমকি দিয়ে আসছিল। আমরা বন্ধ না করে শুক্রবার রাতেও সেখানে নির্বাচনী কাজ করেছি। ঘরে তালা লাগিয়ে রাত ১১টার দিকে আমরা বাড়িতে চলে যাই। গভীর রাতে কার্যালয়টি পুড়তে দেখা যায়। চেষ্টা করেও আগুন নেভানো যায়নি।’
শুক্রবার সকালে শেরকোল ইউনিয়নের তেলিগ্রামে স্থানীয় একটি নদীতে নৌকার অন্তত এক হাজার পোস্টার ভাসতে দেখা যায়। নৌকার কর্মীদের ভাষ্য, বিদ্রোহী প্রার্থীর লোকজন নৌকার ঝোলানো পোস্টার ছিঁড়ে নদীতে ফেলে দিয়েছেন।
এসব ঘটনার বিষয়ে প্রার্থী শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘শেখ হাসিনার হাত থেকে নৌকা প্রতীক পেয়েছি। তাঁর দেওয়া নৌকার প্রতীকের কার্যালয়ে যাঁরা আগুন লাগাচ্ছে, পোস্টার পোড়াচ্ছে, নদীতে পোস্টার ভাসিয়ে দিচ্ছে, তারা তো আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী হতে পারে না।’ তিনি বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের কিছু নেতা-কর্মী বিএনপি থেকে সদ্য যোগ দেওয়া আওয়ামী লীগের একজন সাধারণ কর্মীকে বিদ্রোহী প্রার্থী করেছেন। তাঁকে নিয়ে আমার বিরুদ্ধে প্রচার চালাচ্ছেন।’ শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘আমি বহুবার প্রশাসন ও নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তাদের কাছে আমার পোস্টার ছেঁড়া, পোড়ানো ও কার্যালয় ভাঙচুর ও পোড়ানোর অভিযোগ দিয়েছি। কিন্তু তাঁরা কার্যকর ব্যবস্থা নেননি। তাই বারবার এসব ঘটনা ঘটছে। আদৌ সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে কি না, তা নিয়ে আমি শঙ্কিত।’
তবে বিদ্রোহী প্রার্থী আদেশ আলী সরদার (দোয়াত-কলম) এসব অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে বলেন, ‘আমাকে চাপে ফেলতে নৌকার লোকজনই এসব করছে।’
রিটার্নিং কর্মকর্তা ও নাটোরের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) রাজ্জাকুল ইসলাম জানান, ‘সুকাশে আগুন লাগানোর কথা শুনেছি। তবে সেটা নৌকার নির্বাচনী কার্যালয় কি না, তা জানি না।’ নির্বাচনের ঠিক আগ মুহূর্তে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার লোকজন মাঠে থাকা অবস্থায় কেন এ ধরনের ঘটনা ঘটছে? জানতে চাইলে তিনি বলেন, অভিযোগটি তদন্ত করে দেখা হবে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার (র্যাব-পুলিশ-বিজিবি) লোকজনকে নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে এ ধরনের ঘটনা যেন আর না ঘটে।
স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সিংড়ায় স্থানীয় আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগের অধিকাংশ নেতা এবং ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যানরা বিদ্রোহী প্রার্থীর পক্ষে ভোট চাইছেন। এ ছাড়া প্রতিমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত সিংড়া পৌরসভার মেয়র ও পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জান্নাতুল ফেরদৌস, উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও প্রতিমন্ত্রীর শ্যালক লুৎফুল হাবিব সরাসরি ভোটের মাঠে নৌকার প্রার্থীর বিরুদ্ধে কাজ করছেন। তবে প্রতিমন্ত্রী নিজে ভোটের মাঠে এসে নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘন করেননি। পাশাপাশি দলের এসব প্রভাবশালী নেতাকে দলীয় প্রার্থীর পক্ষে কাজ করার বিষয়ে কোনো নির্দেশনা দেননি বলে জানিয়েছেন নৌকার প্রার্থী শফিকুল ইসলাম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রতিমন্ত্রী চাইলেই নৌকার বিরুদ্ধে নাশকতা বন্ধ করতে পারেন। কিন্তু তিনি ঢাকায় বসে নিশ্চুপ আছেন। তিনি নেতা-কর্মীদের দলীয় প্রতীকের পক্ষে কাজ করার নির্দেশনা দিয়ে মোবাইলে একটি মেসেজ পাঠালেই সব অপতৎপরতা বন্ধ হয়ে যাবে। আমি এখনো সেই মেসেজের অপেক্ষায়।’
জানতে চাইলে জুনাইদ আহমেদ পলক প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি তো অনেক আগেই দলের নেতা-কর্মীদের নৌকার পক্ষে কাজ করতে মেসেজ দিয়েছি।’ নিজের ঘনিষ্ঠজনের বিদ্রোহী প্রার্থীর পক্ষে কাজ করার প্রসঙ্গে প্রতিমন্ত্রী বলেন, এবারের নির্বাচনে বিএনপি নেই। নির্বাচনকে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ করতে অনেক জায়গায় একাধিক প্রার্থী আছেন। সে ক্ষেত্রে সবাই যাঁর যাঁর পছন্দের প্রার্থীর পক্ষে কাজ করছেন। দলের প্রার্থীর পক্ষে নির্বাচনে সরাসরি ভূমিকা রাখার সুযোগ নেই মন্তব্য করে পলক বলেন, ‘নির্বাচনী আচরণবিধি অনুসারে আমি এটা করতে পারি না।’