জমির হোসেন (৪০) হাওরে মাছ ধরে সংসার চালান। ২০ জুন সকালে মাছ ধরতেই নৌকা নিয়ে বেরিয়েছিলেন। মাছ ধরার সময় মসজিদের মাইকে শোনেন, তাঁর ছেলের মৃত্যুর খবর। নৌকা নিয়ে ছুটে এসে দেখেন ছেলে সাদমান হোসেন (৩) আর নেই। বাড়ির পেছনে থাকা বন্যার পানিতে ডুবে সে মারা গেছে।
জমির এই নিয়ে একে একে তিন ছেলেকে হারালেন। বড় ছেলে তৌহিদ ইসলাম (৫) ২০০৮ সালে খালের পানিতে ডুবে মারা যায়। ২০১৩ সালে বাড়ির সামনে আসা পাহাড়ি ঢলের পানিতে মারা যায় আরেক ছেলে মোজাহিদ ইসলাম (৪)। জমির ও জেসমিন বেগম দম্পতির এখন একটি ছেলেসন্তান রয়েছে। তার নাম সাইয়ান হোসেন। বয়স ২ বছর।
জমির সুনামগঞ্জের দোয়ারাবাজার উপজেলার সুরমা ইউনিয়নের শরীফপুর গ্রামের বাসিন্দা। তাঁর বাড়ির উঠানে বন্যার পানি আসে ১৬ জুন মাঝরাতে। পরদিন সকালের মধ্যেই ঘরের ভেতরেও প্রায় হাঁটুসমান পানি উঠে যায়। পরিস্থিতি খারাপ দেখে স্ত্রী-সন্তানকে নিয়ে ঘর ছাড়েন জমির। চলে যান শরীফপুর ও বড়ইকান্দি গ্রামের মাঝামাঝি স্থানের একটি কারিগরি কলেজের নির্মাণাধীন ভবনে। সেখানেই আশপাশের কয়েকটি গ্রামের বাসিন্দা আশ্রয় নিয়েছিলেন।
‘আমার তিন ফুয়ারে পানিয়ে মারিলাইছে। ইবার ই পানি আমার সাদমানরেও ঢুবাইয়া মারল। আল্লাহ, আমি কিতা দুষ করছি।’জমির হোসেন
দোয়ারাবাজার উপজেলাটি ভারতের মেঘালয় রাজ্যের সীমান্তঘেঁষা। এবার বন্যার শুরুতেই পানি প্রচণ্ড বেগে ওই উপজেলার বিভিন্ন এলাকা প্লাবিত করে। তাতে শরীফপুরসহ উপজেলার সুরমা ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামের মানুষের ঘরবাড়ি প্লাবিত হয়। দুই দিন পরেই শরীফপুর গ্রামের বাসিন্দাদের ঘরের ভেতরের পানি নেমে যায়। এতে অনেকেই নিজেদের বাড়ি ফিরে আসেন। কারণ, নির্মাণাধীন ভবনে থাকার মতো অবস্থা ছিল না।
জমির হোসেনের পরিবারও বাড়ি ফিরেছিল। ছেলে সাদমান যখন পানিতে ডুবে মারা যায়, তখন মাছ ধরতে যাওয়া জমিরকে তা জানানোর উপায় ছিল না। কারণ, বন্যা পরিস্থিতিতে বিদ্যুৎ–সংযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ার কারণে কারও মুঠোফোনে চার্জ ছিল না। পরে মসজিদের মাইকে জমিরকে ডাকা হয়।
গতকাল জমিরের বাড়িতে গেলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার তিন ফুয়ারে পানিয়ে মারিলাইছে। ইবার ই পানি আমার সাদমানরেও ঢুবাইয়া মারল। আল্লাহ, আমি কিতা দুষ করছি।’ তিনি আরও বলেন, ‘সবর ঘর ভাঙছে, বাড়ি ভাঙছে। বহুত্তা নষ্ট অইছে। ইটিন আবার ফাওয়া যাইব। কিন্তু আমার ফুরারে আর কুনো সময় ফেরত পাইতাম না।’
সুরমা ইউনিয়নেরই আরও দুজন মারা গেছে। তারা দুই ভাই–বোন—এসএসসি পরীক্ষার্থী তামান্না আক্তার ও পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র সৌরভ মিয়া (১০)। তামান্নাদের গ্রামের বাড়ি রাজনগর। সে সমুজ আলী উচ্চবিদ্যালয় ও কলেজের এসএসসি শিক্ষার্থী ছিল। ১৬ জুন সকাল ১০টার দিকে ছোট ভাই সৌরভকে সঙ্গে নিয়ে সে নৌকায় করে স্কুল থেকে পরীক্ষার প্রবেশপত্র আনতে যাচ্ছিল। তখন বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে তাদের নৌকাটি ডুবে যায়। এতে তাদের মৃত্যু হয়। ১৯ জুন থেকে সারা দেশে এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল।
‘আমি ঘটনা শুনেই ওই ভাই–বোনকে দেখতে যাই। ঘটনাটি খুবই মর্মান্তিক। তাৎক্ষণিক সরকারের পক্ষ থেকে ওই পরিবারকে ৪০ হাজার টাকা সহায়তা দেওয়া হয়।’ফারজানা প্রিয়াংকা, দোয়ারাবাজার উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও
তামান্নাদের বাড়ি গিয়ে গতকাল দেখা যায়, পরিবারের সবাই দুই ভাইবোনের মৃত্যুশোকে কাতর। ঘরের ভেতরে বিছানায় শুয়ে ছিলেন ওদের মা আফরোজা বেগম। মুঠোফোনে সন্তানদের ছবি দেখছিলেন আর কিছুক্ষণ পরপর ডুকরে কেঁদে উঠছিলেন তিনি। কাঁদতে কাঁদতেই তাঁকে বলতে শোনা যায়, ‘আল্লাগো তুমি আমার সবতা ভাসাই নিতায়। আমার কুনো দুঃখ আছিল না। তুমি কেনে আমার দুই বাইচ্চারে তোমার কাছে নিলায়। তারের থুইয়া আমি কিলা বাঁচমুগো আল্লাহ।’
পরিবারের অন্য সদস্যরা জানালেন, তামান্নার আরেক বোন আছে, নাম আফসানা আক্তার। বিয়ের পর তিনি স্বামীর সঙ্গে থাকেন।
দোয়ারাবাজার উপজেলা প্রশাসনের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ওই উপজেলার বন্যায় মোট তিনজন মারা গেছে। বজ্রপাতে মারা গেছে চারজন। আর সুরমা ইউনিয়নে বজ্রপাতে এই দুই ভাইবোন মারা গেছে। দোয়ারাবাজার উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ফারজানা প্রিয়াংকা প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি ঘটনা শুনেই ওই ভাই–বোনকে দেখতে যাই। ঘটনাটি খুবই মর্মান্তিক। তাৎক্ষণিক সরকারের পক্ষ থেকে ওই পরিবারকে ৪০ হাজার টাকা সহায়তা দেওয়া হয়।’
দোয়ারাবাজার উপজেলার সুরমা ইউনিয়নের শরীফপুর, বরইকান্দি, ভাগরা ও রাজনগর গ্রামে গতকাল দেখা যায়, মানুষের বাড়িঘর থেকে বন্যার পানি নেমে গেছে। তবে কারও কারও ঘরের উঠানে কিংবা উঠান ঘেঁষে এখনো বন্যার পানি রয়েছে।
এক বাড়ি থেকে অন্য বাড়ি যাওয়ার রাস্তাগুলোও এখনো পানির নিচে। এসব রাস্তায় কোথাও হাঁটুপানি, কোথাও আবার কোমর ছুঁই ছুঁই। এরই মধ্যে মানুষের কষ্টের জীবন। কোনো কোনো বাড়িতে স্বজন হারানোর শোক।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, বন্যার কারণে দেশে গত ১৭ মে থেকে এ পর্যন্ত ৮৭ জনের মৃত্যু হয়েছে।