বাড়িঘরে বন্যার পানি ঢোকা শুরু করেছিল গত বৃহস্পতিবার (১৬ জুন) রাতে। প্রথমে ঘরেই থাকার চেষ্টা করেছিলেন বিলকিছ বেগম (৩৭)। কিন্ত পানি বাড়তে থাকায় ঘরে থাকা দায় হয়ে পড়ে। এ অবস্থায় রাতেই বৃষ্টি মাথায় কোমরপানি ভেঙে কলেজের ভবনে আশ্রয় নেন। পরিস্থিতি ভয়াবহ থাকায় খালি হাতেই ঘর থেকে বের হয়েছিলেন। এক সপ্তাহের মাথায় ঘর থেকে পানি নামলেও পরিবার নিয়ে সুনামগঞ্জ শহরের সরকারি কলেজ আশ্রয়কেন্দ্রেই থাকছেন বিলকিছ।
আজ বৃহস্পতিবার দুপুরে কলেজে গিয়ে কথা হয় বিলকিছের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘পানি নামছে। কিন্তু ঘরের বেড়া, মেঝে ভাঙছে। হাতে টাকাপয়সা নাই। ছেলেরে বলছি, কারও কাছ থেকে ধার আনতে। ঘরের কাজ করেই বাড়িতে যাব।’ স্বামী-সন্তান নিয়ে পাঁচ সদস্যের সংসার বিলকিছের। স্বামী শাহ আলম একসময় ট্রাক চালাতেন। এখন অসুস্থ হয়ে আর কোনো কাজ করতে পারেন না। বড় ছেলে তফাজ্জুল হোসেন (১৫) গাড়ির গ্যারেজে কাজ করেই সংসার চালায়।
বন্যায় ঘরবাড়ি প্লাবিত হওয়ায় সুনামগঞ্জ শহরের সরকারি কলেজে ১৬ জুন বৃহস্পতিবার রাতে পাশের সুলতানপুর, গাঙপার হাটি ও আশপাশের ৭৫টি পরিবার আশ্রয় নেয়। এসব পরিরাবের পুরুষের বেশির ভাগই দিনমজুর। কেউ কেউ ঠেলা ও রিকশা চালান। তাঁদের অনেকের বাড়িঘর থেকে পানি নেমেছে। কিন্তু কারও কারও ঘর পুরো ভেঙে পড়েছে। কারও ঘরের বেড়া, মেঝে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অনেকের আসবাব, কাপড়চোপড় পানিতে ভেসে গেছে। তাই তাঁরা বাড়ি ফিরতে পারছেন না। আবার কারও কারও ঘরে এখনো পানি।
আজ দুপুরে কলেজে গিয়ে দেখা গেছে, বেশির ভাগ পরিবার এখনো বাড়িতে ফেরেনি। দুটি কক্ষে আছেন এসব পরিবারের সদস্যরা। মিলনায়তনের মেঝেতে ভাগ করে নিজেদের জায়গা করে নিয়েছে পরিবারগুলো। অন্য কক্ষে বেঞ্চ দিয়ে ভাগ করা হয়েছে। ঘরের ভেতরেই রান্নাবান্না ও খাওয়াদাওয়া চলছে।
সুলতানপুরের দেলোয়ার হোসেন (৩৫) জানান, ঘর থেকে পানি নামলেও এখনই যাওয়ার সুযোগ নেই। ঘরের একদিক ধসে পড়েছে। আসবাবপত্র সব পানিতে ভেসে গেছে। ঘরে কোনো জিনিসপত্রের ঠিক নেই। দেলোয়ার হোসেনের মা খুদিজা বেগম (৫৪) বলেন, এ পরিবেশে থাকা তো খুবই কষ্টের। তবু আছেন। পানি নামলেও ঘরের ভেতরে পা দেওয়া যাচ্ছে না। একদিকে বেড়া নেই, হাওর দেখা যায়। এ ঘরে থাকা মুশকিল।
শ্রমিক শরিফ উদ্দিন (৪০) বলেন, ‘কোনো আয়রোজগার নাই। বেকার আছি। এখন ঘরসংস্কারের টাকা পাই কই। সরকার সহযোগিতা না করলে তো ঘরের কাজ করা সম্ভব নয়।’
শহরের ষোলঘর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, বড়পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, সুনামগঞ্জ বালিকা উচ্চবিদ্যালয়, সদর হাসপাতাল, শহরতলির মইনপুর প্রাথমিক বিদ্যালয় ঘুরে একই চিত্র পাওয়া গেছে।
বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ে থাকা হাসননগর এলাকার বাসিন্দা শ্রমিক রুকন মিয়া (৪৮) বলেন, তাঁর পুরো ঘরটি হাওরের ঢেউয়ে ভেঙে গেছে। এখন বউ-বাচ্চাদের নিয়ে কোথায় যাবেন, এ চিন্তায় অস্থির। রুকন মিয়া বলেন, ‘খাইয়া না খাইয়া দিন যার। ঘর বানাইমু কিলা। স্কুল ত ছাড়ত অইব। এখন পথে নামা ছাড়া আমার কোনো উপায় নাই।’
শুধু শহর নয়, গ্রামেও একই অবস্থা। অনেকেই আশ্রয়কেন্দ্র থেকে বাড়িতে ফিরতে পারছেন না। সদর উপজেলার মইনপুর গ্রামের বাসিন্দা মরতুজ আলী বলেন, মানুষ তো এখন বাড়ির চিন্তায় আছে। মানুষের হাতে টাকাপয়সা নেই। সরকার সাহায্য না করলে ঘরে যেতে পারবেন না।
সুনামগঞ্জ পৌরসভার মেয়র নাদের বখত বলেন, এমনিতে বন্যার্তদের মধ্যে প্রয়োজনীয় ত্রাণসহায়তা বিতরণ করা হচ্ছে। কিন্তু এখন তাঁদের ঘরবাড়ি সংস্কারে সহায়তা দরকার। পৌর এলাকাতেই অন্তত তিন হাজার ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অনেক মানুষ ঘরবাড়ি সংস্কার করতে সহায়তার জন্য আসছেন।
তাহিরপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. রায়হান কবির জানান, তাঁর উপজেলায় চার হাজার ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অনেকের ঘরবাড়ি সম্পূর্ণ ভেঙে গেছে। এখনো আশ্রয়কেন্দ্রে এক হাজারের মতো মানুষ আছেন। তাঁদের অনেকেই ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় ফিরতে পারছেন না। বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার ইউএনও মো. সাদি উর রহিম জাদিদ জানান, তাঁরা এখন পর্যন্ত পাঁচ হাজার ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার তথ্য পেয়েছেন। এটা আরও বাড়বে।
সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক মো. জাহাঙ্গীর হোসেন জানান, পানি নামার সঙ্গে সঙ্গে ক্ষয়ক্ষতির বিষয়টি দেখা হচ্ছে। তবে এখনই পূর্ণাঙ্গ চিত্র পাওয়া যাবে না। পুনর্বাসন কার্যক্রম শুরু হলে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিরা সহায়তা পাবেন।