পাঁচ বছরে ৯৬ হাজার অগ্নিকাণ্ড, মৃত্যু ৪৭৯
অগ্নিকাণ্ডের ৩৭ ভাগের সূত্রপাত হয় শর্টসার্কিট থেকে। শর্টসার্কিটের পর বেশি অগ্নিকাণ্ড ঘটে চুলার আগুন থেকে।
বাংলাদেশে অগ্নিকাণ্ডে মৃত্যুর প্রধান কারণ বৈদ্যুতিক গোলযোগ বা শর্টসার্কিট। গত পাঁচ বছরে বাংলাদেশে ৯৬ হাজার অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে শর্টসার্কিট থেকে অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত হয়েছে ৩৫ হাজার ৫৯৮ টি। অর্থাৎ অগ্নিকাণ্ডের ৩৭ ভাগের সূত্রপাত শর্টসার্কিট থেকে। এই সময়ের মধ্যে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় মারা গেছেন ৪৭৯ জন। এই অগ্নিকাণ্ডে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ২ হাজার কোটি টাকা। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে এসব তথ্য জানা গেছে।
আমাদের দেশে অগ্নিকাণ্ডের যত ঘটনা ঘটে, তার বেশির ভাগের সূত্রপাত কিন্তু শর্টসার্কিট থেকে। আমরা নিম্নমানের ইলেকট্রিক যন্ত্রাংশ অফিস, বাসা-বাড়ি, কারখানায় ব্যবহার করি। এসব যন্ত্রাংশ ঠিকঠাক আছে কি না, সে ব্যাপারেও আমরা উদাসীন। এর ফলে প্রায়ই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। মানুষ মারা যায়। কিন্তু আমরা সচেতন হচ্ছি নালে. কর্নেল জিল্লুর রহমান , ফায়ার সার্ভিসের অপারেশনস ও মেইনটেন্যান্স বিভাগের পরিচালক
ফায়ার সার্ভিসের প্রতিবেদন বলছে, শর্টসার্কিটের পর বেশি অগ্নিকাণ্ড ঘটে চুলার আগুন থেকে। শতকরা ১৮ ভাগ অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত চুলার আগুন থেকে হয়। আর ১৫ ভাগ অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত সিগারেটের আগুন থেকে।
ফায়ার সার্ভিসের অপারেশনস ও মেইনটেন্যান্স বিভাগের পরিচালক লে. কর্নেল জিল্লুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের দেশে অগ্নিকাণ্ডের যত ঘটনা ঘটে, তার বেশির ভাগের সূত্রপাত কিন্তু শর্টসার্কিট থেকে। আমরা নিম্নমানের ইলেকট্রিক যন্ত্রাংশ অফিস, বাসা-বাড়ি, কারখানায় ব্যবহার করি। এসব যন্ত্রাংশ ঠিকঠাক আছে কি না, সে ব্যাপারেও আমরা উদাসীন। এর ফলে প্রায়ই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। মানুষ মারা যায়। কিন্তু আমরা সচেতন হচ্ছি না।’
গত পাঁচ বছরে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ফায়ার সার্ভিসের দেওয়া প্রতিবেদন বলছে, গত বছর (২০১৯) অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় মারা গেছেন ১৮৪ জন। ২০১৮ সালে মারা গেছেন ১৩০ জন, ২০১৭ সালে ৪৫,২০১৬ সালে ৫২ এবং ২০১৫ সালে মারা গেছেন ৬৮ জন।
৪ সেপ্টেম্বর রাতে নারায়ণগঞ্জের তল্লায় বায়তুস সালাত মসজিদে বিস্ফোরণ থেকে সূত্রপাত হওয়া অগ্নিকাণ্ডে মারা গেছেন ২৭ জন।
ঢাকার শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের সমন্বয়ক চিকিৎসক সামন্ত লাল সেন প্রথম আলোকে বলেন, পাঁচ থেকে ছয় বছরে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা অনেক বেড়েছে। এসব ঘটনায় মৃত্যুর মিছিল ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। শর্টসার্কিট থেকে, চুলার গ্যাস থেকে, বিস্ফোরক দ্রব্য, এসি বিস্ফোরণ, বয়লার বিস্ফোরণ, সিলিন্ডার বিস্ফোরণের ঘটনা অনেক বেড়েছে। কে কোন জায়গা থেকে ইলেকট্রিক যন্ত্রাংশ অফিসে, বাসায় ব্যবহার করছে, সেগুলো বৈধ না অবৈধ, তা মনিটরিং করার কেউ নেই।
বাংলাদেশের বেশির ভাগ অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত হচ্ছে বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট থেকে। কারণ আমরা বৈদ্যুতিক নিরাপত্তার জন্য নিয়মকানুন মেনে বৈদ্যুতিক যন্ত্রাংশের ব্যবহার করছি না। প্রায় সব বাসা-বাড়িতে আমরা নিম্নমানের বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম ব্যবহার করছি। নিম্নমানের এই সরঞ্জামই বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিটের অন্যতম কারণমো. জিয়াউর রহমান খান, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক
অগ্নিকাণ্ডের প্রধান কারণ শর্টসার্কিট
গত বছরের ২৮ মার্চ বনানীর এফআর টাওয়ারে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় মারা যান ২৫ ব্যক্তি। ২২ তলা ওই ভবনে অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত হয়েছিল বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট থেকে। আর গত বছরের ২০ ফেব্রুয়ারি পুরান ঢাকার চুড়িহাট্টার ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে মারা যান ৭১ জন। স্মরণকালের ভয়াবহ ওই অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত হয়েছিল রাসায়নিক গুদাম থেকে। ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনের প্রতিবেদন অনুযায়ী, চুড়িহাট্টার ওয়াহেদ ম্যানশনের দোতলায় বৈদ্যুতিক সুইচ অন করার সময় স্ফুলিঙ্গ (শর্টসার্কিট) থেকে বা অসাবধানতাবশত জ্বালানো আগুন থেকে এই অগ্নিকাণ্ড ঘটে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক মো. জিয়াউর রহমান খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাংলাদেশের বেশির ভাগ অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত হচ্ছে বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট থেকে। কারণ আমরা বৈদ্যুতিক নিরাপত্তার জন্য নিয়মকানুন মেনে বৈদ্যুতিক যন্ত্রাংশের ব্যবহার করছি না। প্রায় সব বাসা-বাড়িতে আমরা নিম্নমানের বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম ব্যবহার করছি। নিম্নমানের এই সরঞ্জামই বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিটের অন্যতম কারণ।’
মৃত্যুর জন্য দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তি জরুরি
পুরান ঢাকার চুড়িহাট্টার আগুনে ৭১ জনের মৃত্যুর ঘটনায় চকবাজার থানায় মামলা হয়। সেই মামলায় চকবাজার থানা-পুলিশ এখনো আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়নি। একইভাবে বনানীর এফআর টাওয়ারের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় দায়ের করা মামলায়ও পুলিশ আদালতে প্রতিবেদন জমা দেয়নি। আসামিরা জামিনে আছেন।
চকবাজার থানার ওসি মওদুত হাওলাদার প্রথম আলোকে বলেন, দুজন আসামিকে গ্রেপ্তার করা যায়নি। যে কারণে তদন্ত প্রতিবেদন আটকে আছে।
অগ্নিকাণ্ডের দুর্ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিপুল অঙ্কের আর্থিক ক্ষতিপূরণ দেওয়ার বিধান করা জরুরি বলে মনে করেন সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি এ এ এম আমিন উদ্দিন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের দেশে অহরহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় মানুষ মারা যাচ্ছে। মৃত্যুর মিছিল বাড়ছে। এই মৃত্যুর মিছিল থামানোর জন্য প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষকে যেমন সজাগ থাকতে হবে, তেমনি দোষীদের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।’
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহদীন মালিক প্রথম আলোকে বলেন, এসব ক্ষেত্রে ফৌজদারি মামলা করে দোষীর শাস্তি নিশ্চিত করা সব থেকে দুরূহ। ফৌজদারি বিচারে কোনো দোষীর অবহেলাজনিত অপরাধের জন্য তিন বা পাঁচ বছরের কারাদণ্ড হলেও ভুক্তভোগী কোনো রকম আর্থিক ক্ষতিপূরণ পান না। অথচ ভুক্তভোগীরা আর্থিক ক্ষতিপূরণের মামলা করলে সাফল্যের সম্ভাবনা অনেক বেশি।