পটিয়ার আশ্রয়ণ প্রকল্প রাজনৈতিক রোষানলে
রাজনৈতিক এবং স্বার্থের দ্বন্দ্বের আঁচ লেগেছে চট্টগ্রামের পটিয়ায় নির্মীয়মাণ প্রধানমন্ত্রীর আশ্রয়ণ প্রকল্পে। এখানে গৃহহীনদের জন্য নির্মিত ঘরের ভেন্টিলেটর ভেঙে দেওয়া, ইটপাটকেল নিক্ষেপ, নির্মাণসামগ্রী চুরি এবং ঘরের তালা ভেঙে ফেলার অভিযোগ উঠেছে। তবে নবনির্মিত কিছু ঘরের মেঝেতে ছোট ছোট ফাটল রয়েছে। প্রকল্পসংশ্লিষ্টদের দাবি, কাজের নিম্নমান দেখানোর জন্য রাজনৈতিক ও প্রভাবশালী একটি পক্ষ উঠেপড়ে লেগেছে।
বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে গৃহহীনদের জন্য সারা দেশের মতো চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার হাইদগাঁও গুচ্ছগ্রাম এলাকায় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের ১৭০টি ঘর নির্মাণ করা হচ্ছে। একইভাবে ভূমি মন্ত্রণালয়ের অধীনে ৬০টি পৃথক ঘর নির্মিত হচ্ছে।
হাইদগাঁও পাহাড়ি এলাকায় যেখানে বাড়িগুলো নির্মিত হয়েছে সেখানে প্রচুর বন রয়েছে। সরকারি খাসজমির গাছপালাগুলো বিভিন্ন প্রভাবশালী ব্যক্তির দখলে ছিল। এ ছাড়া সন্ত্রাসীদের আস্তানাও ছিল এসব এলাকায়। বসতি হওয়ার কারণে তারা অখুশি। তাদের মধ্যে চিহ্নিত সাইফুল ইসলাম ও ভোলাসহ কয়েকজন প্রকাশ্যে সেখানে গিয়ে বাসিন্দাদের হুমকি দিয়েছেন এবং ভাঙচুর করেছেন বলে অভিযোগ। এই তিনজনের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা রয়েছে। তাঁদের বিরুদ্ধে আশ্রয়ণ প্রকল্পে বাধাদানের অভিযোগে একটি জিডি করেছেন আবুল হাসান নামে এক নির্মাণসামগ্রী সরবরাহকারী।
এ ছাড়া পটিয়ার সাংসদ হুইপ সামশুল হক চৌধুরীর বিরুদ্ধে এলাকায় একটি বিরোধী পক্ষ সক্রিয় রয়েছে। কিছুদিন আগে চট্টগ্রাম ও পটিয়ায় সাংসদ এবং তাঁর ছেলে নাজমুল করিম চৌধুরীর বিরুদ্ধে আন্দোলন হয়েছিল। আশ্রয়ণ প্রকল্পের দুর্নামও ওই পক্ষটি ছড়াচ্ছে বলে মনে করছেন সাংসদের অনুসারীরা।
উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মোতাহেরুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, রাতের অন্ধকারে এসে ঘর ভেঙে দিচ্ছে স্বাধীনতার বিপক্ষের শক্তি। এ কাজে আরেকটি শক্তি রয়েছে। হুইপের জনপ্রিয়তায় ঈর্ষান্বিত হয়ে তারাও ঘর ভেঙে দিচ্ছে। কিছু সন্ত্রাসী রয়েছে। তারা চায় বসতি না হোক।
ইতিমধ্যে প্রায় ১৪০টি ঘরের নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে। দুই শতক জমির ওপর দুই কামরার প্রতিটি ঘরে একটি করে রান্নাঘর এবং শৌচাগার রয়েছে। ১ লাখ ৭১ হাজার টাকায় প্রতিটি ঘর নির্মিত হয়। নবনির্মিত ঘরের মধ্যে ইতিমধ্যে শ খানেক হস্তান্তর করা হয়েছে ভূমিহীনদের।
সরেজমিনে বৃহস্পতিবার দেখা গেছে, অন্তত ৫০টি ঘরের ভেন্টিলেটর ভাঙা পড়ে রয়েছে। ১০টি ঘরের টিনের চালে এখনো বড় বড় পাথর রয়েছে। খালেদা বেগম নামে এক বাসিন্দা বলেন, রাতে কে বা কারা পাথর ছুড়ে মেরেছে।
একটি ঘরের জানালা খুলে ফেলা হয়েছে। ওই ঘর থেকে দুই মাস আগে ১৩ বস্তা সিমেন্ট চুরি হয় বলে জানান দায়িত্বপ্রাপ্ত মিস্ত্রি মো. লোকমান। তিনি বলেন, নির্মাণকাজে ব্যবহৃত তিনটি পানির পাম্পও ইতিমধ্যে চুরি হয়েছে।
উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) সুপ্তশ্রী সাহা প্রথম আলোকে বলেন, স্থানীয় রাজনৈতিক রোষানলে পড়েছে আশ্রয়ণ প্রকল্প। এ কারণে দুর্বৃত্তরা এসব ঘটনা ঘটাচ্ছে বলে মনে করি। তারা চায় না এই প্রকল্প সফল হোক। তাই ভেন্টিলেটর ভেঙে দেওয়া, ইটপাটকেল মেরে ভয় দেখানো হয়।
এ নিয়ে ১৩ জুলাই পটিয়া থানায় সাধারণ ডায়েরি করেন সুপ্তশ্রী সাহা। তাতে ১০ জুলাই রাতে অজ্ঞাত ব্যক্তিরা বাসিন্দাদের ভয়ভীতি ও হুমকি দেন বলে অভিযোগ করা হয়। ইটপাটকেল ছুড়ে মারার অভিযোগও করেন। পটিয়া থানার ওসি রেজাউল করিম জিডির তদন্ত চলছে বলে জানান।
কেন্দ্রীয় যুবলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বদিউল আলম সাংসদের বিরোধী পক্ষ হিসেবে পরিচিত। তিনি নিজে গতবার পটিয়ায় সংসদ সদস্য পদে দলীয় মনোনয়ন চেয়েছিলেন। বদিউল আলম ১৩ জুলাই আশ্রয়ণ প্রকল্প পরিদর্শনে গিয়ে বাসিন্দাদের মধ্যে ত্রাণ বিতরণ করেছেন।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হওয়া একটি ভিডিওতে দেখা যায়, প্রকল্প এলাকায় ট্রাক থেকে শৌচাগারের রিং নামানোর সময় এক ব্যক্তি শ্রমিককে নির্দেশ দিচ্ছেন ওপর থেকে ফেলার জন্য। একজন জবাবে বলে উঠলেন, ওপর থেকে ফেললে ভেঙে যাবে। তখন সেখানে বদিউল আলম দাঁড়িয়ে ছিলেন। পরে দেখা যায়, রিংটি ওপর থেকে ফেলার সঙ্গে সঙ্গে ভেঙে যায়। তখন আশপাশ থেকে চেঁচামেচি শুরু হয় কাজের নিম্নমান নিয়ে।
জানতে চাইলে বদিউল আলম বলেন, ‘আমি সেখানে ত্রাণ দিয়েছি। পানি ছিল না। আমি আসার পর টিউবওয়েল বসানোর কাজ শুরু করেছে। কোথায় কোনো জায়গায় যদি ভুল হয়ে থাকে সেটা সংশোধনযোগ্য। যারা অপরাধ করবে তাদের শাস্তি হওয়া দরকার। আমরা রাজনীতি করি। দ্বন্দ্ব থাকতে পারে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর আশ্রয়ণ প্রকল্প নিয়ে কোনো রাজনীতি নেই। উন্নয়ন নিয়ে কোনো দ্বিমত নেই।’
নিম্নমানের কাজের অভিযোগ এবং দুষ্কৃতকারীদের হামলার পর প্রকল্প এলাকা পরিদর্শন করেছেন চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মমিনুর রহমান। তিনি বলেন, এত কম টাকায় এমন সুন্দর ঘর তৈরি হয়েছে। কিন্তু কিছু দুষ্কৃতকারী এখানে ভয়ভীতি দেখাচ্ছে। তারা এত দিন এই জায়গা থেকে সুবিধা পেত।
জানতে চাইলে হুইপ সামশুল হক চৌধুরী বলেন, ‘কিছু সন্ত্রাসী ও ডাকাত যারা একসময় আমাদের দলে ছিল তারা আশ্রয়ণ প্রকল্পে ভয়ভীতি দেখাচ্ছে। আমি তাদের দল থেকে তাড়িয়ে দিয়েছি। পটিয়ায় আমি যেভাবে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড করেছি, এতে কেউ কেউ ঈর্ষান্বিত। কেউ কেউ মনে করছেন এই আসন আমার কাছ থেকে আর যাবে না। তাই নানা ষড়যন্ত্র করছে।’
সরবরাহকারীরা সরকারদলীয়
জেলা প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে এই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হচ্ছে দরপত্র ছাড়া। তদারক করছেন পিআইও। এখানে যাঁরা নির্মাণসামগ্রী সরবরাহ করেছেন তাঁরা সরকারদলীয় লোকজন। এর মধ্যে জঙ্গলখাইন ইউনিয়ন যুবলীগের আহ্বায়ক আবুল হাসান, ভাটিখাইন ইউনিয়ন যুবলীগের সভাপতি নাজিম উদ্দিন, উপজেলা যুবলীগের সাবেক সহসভাপতি মাহমুদুল হক ও উপজেলা যুবলীগের সদস্য এনামুল হক মজুমদার অন্যতম।
সরেজমিনে কয়েকটি ঘরের মেঝেতে ছোট ছোট ফাটল দেখা গেছে। পরে সেগুলো পুনরায় মেরামত করে দেওয়া হয়। সরবরাহ করা কাঠও নিম্নমানের। নিম্নমানের কাজ সম্পর্কে সুপ্তশ্রী বলেন, ‘নিজেরা এই নির্মাণকাজ করছি। কিছু সরবরাহকারী রয়েছেন। তাঁরা কে কোন রাজনীতি করে তা দেখিনি। কম বাজেটের মধ্যে সাধ্যমতো চেষ্টা করেছি ভালো কাজ করার। কিন্তু বালুমাটির কারণে কিছু সমস্যা হচ্ছে।’