নৃপেন্দ্র নাথের চালে ফুটো, ঘরে বন্যার পানি

মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার হাকালুকি হাওরপাড়ের জয়চন্ডী ইউনিয়নের আবুতালিবপুর গ্রামের বাসিন্দা নৃপেন্দ্র নাথ ঘরের বেড়া ঠিক করছেন। ছবি গত শনিবার তোলা
ছবি: প্রথম আলো

প্রায় দেড়-দুই মাস আগে ঢলের পানিতে তলিয়ে গেছে বোরো ধান। ফসল আর ঘরে তোলা হয়নি। সংসারে অভাব-অনটন লেগেই আছে। এর মধ্যে ঘরের চালে অনেক ফুটো। বৃষ্টি এলেই ঘরের ভেতরে ফোঁটায় ফোঁটায় ঝরে পানি। এই যখন নৃপেন্দ্র নাথের (৬০) ঘর-সংসারের দশা, তখন নতুন করে যুক্ত হয়েছে হাকালুকি হাওরের বন্যার পানি।

হাওরের পানি এখন তাঁর ঘরে-বাইরে খেলা করছে। ঘরটা এরই মধ্যে অনেকটা হেলে গেছে। কখন যে পড়ে যায়, তা নিয়েই যত দুশ্চিন্তা। নৃপেন্দ্র নাথের বাড়ি মৌলভীবাজারের কুলাউড়ার হাকালুকি হাওরপারের জয়চন্ডী ইউনিয়নের আবু তালিবপুর গ্রামে।

নৃপেন্দ্র নাথ প্রথম আলোকে বলেন, ‘নিজর জমি নাই। ভাগ চাষ (বর্গা চাষ) করি। দুই কিয়ার (বিঘা) জমিত বোরো ধান করছিলাম। প্রথম দফার বন্যায় জমির ধান পানিত ডুবি গেছে। এক মুইঠ ধানও পাইছি না। আর এবার বন্যায় ঘরর ভিতর আটুপানি (হাঁটুপানি) অইছে। টিকতাম কেমনে। এই অবস্থায় না খাইতাম, না ঘর বানাইতাম।’

নৃপেন্দ্র নাথের বাড়ির পথে কোথাও হাঁটুপানি, কোথাও কোমরপানি। ১৮ জুন হাকালুকি হাওরের পানি তাঁর ঘরে ঢোকে। ঘরে থাকা চাল পানিতে ভিজে নষ্ট হয়ে গেছে। চারদিকে পানি, কোথাও সরানোর সুযোগ মেলেনি। তার পর থেকেই পানির সঙ্গেই বসবাস তাঁদের। একমাত্র ছেলে নয়ন দেবনাথ রংমিস্ত্রির সহকারী হিসেবে কাজ করেন। বন্যার পর থেকে তাঁরও কোনো কাজ নেই।

নৃপেন্দ্র নাথ জানান, অনেক দিন ধরেই ঘরের টিনের চাল ছিদ্র হয়ে আছে। বৃষ্টি হলেই ফুটোর নিচে ডেকচি নিয়ে তাঁদের বসে থাকতে হয়, যাতে বৃষ্টিতে ঘরের বিছানা, কাপড়চোপড় ভিজে না যায়। অনেক বৃষ্টির রাত না ঘুমিয়েই কাটে তাঁদের। ঘরে সঞ্চয়ও নেই, আয়রোজগারও নেই। ত্রাণের কিছু চাল পেয়েছিলেন, তাই দিয়ে কোনোরকমে চলছে। এখন ত্রাণই ভরসা। তবে চাল-ডাল হয়তো কারও না কারও কাছ থেকে কিছু মিলতে পারে। কিন্তু ঘরটা নিয়ে এখন বড় দুশ্চিন্তায় আছেন নৃপেন্দ্র নাথ। পানিতে ডুবে থাকায় ঘরের চারপাশের বাঁশের বেড়া পচে গেছে। পানির ঢেউয়ে বেড়া টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে পড়ছে। কোনোরকমে জোড়াতালি দিয়ে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করছেন।

নৃপেন্দ্র নাথ বলেন, ‘এত পানি এর আগে আর দেখছি না। ঘরটা এলি রইছে (হেলে আছে)। টিকাইবার লাগি জোড়াতালি দিরাম (দিচ্ছি)। কতটুকু টিকাইতাম পারমু, বোঝরাম না। ঘরটা পড়লে মাথা থইবার (রাখার) আর জায়গা থাকত নায়।’ ঘর হারানোর ভয়ের মধ্যেই এখন নৃপেন্দ্র নাথ ও তাঁর পরিবারের সময় কাটছে।

স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, হাকালুকি হাওরের বন্যার পানিতে গ্রামের আরও অনেকেরই অবস্থা খারাপ। পথঘাটে পানি। প্রায় সবার বাড়িতেই বন্যার পানি প্রবেশ করেছে। পানির মধ্যেই লোকজনকে চলাচল করতে হচ্ছে।

জয়চন্ডী ইউনিয়ন পরিষদের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য বিমলেন্দু শেখর দাস আজ সোমবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘তাঁর (নৃপেন্দ্র নাথের) ঘরে পানি উঠছে। ঘরের অবস্থা খুব খারাপ। চাইরদিকে ঢিকা দিয়া রাখছে (চারদিক থেকে ঠেস দিয়ে রেখেছে)। আমার কাছে দেওয়ার মতো যা আয় (আসে), তা–ই দিই। দুই দিন ত্রাণ দিছি। তাঁর ঘরর লাগি ইউএনওর কাছে একটা আবেদন করা আছে। যাঁর ভিটা আছে ঘর নাই, এই প্রকল্প থাকি (থেকে) ঘর বানানোর জন্য। ঘর বানানোর এ বরাদ্দ এখন আর (আসছে) না। আসলে হয়তো একটা ব্যবস্থা অইব (হবে)।’

কুলাউড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এ টি এম ফরহাদ চৌধুরী বলেন, ‘বন্যাপরবর্তী সময়ে তাঁর ঘরের একটা ব্যবস্থা করব।’