রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলে ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের দখলদারত্ব, আসন বাণিজ্য, শিক্ষার্থীদের নিপীড়ন-নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতীকী অনশনে বসেছেন অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন খান। আজ রোববার সকাল ১০টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন ভবনের সামনে শামসুজ্জোহা চত্বরে তিনি এই কর্মসূচি পালন করেন। তিনি বেলা দুইটা পর্যন্ত সেখানে অবস্থান করেন।
এর আগে গতকাল শনিবার তিনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে এই কর্মসূচির ঘোষণা দেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের আসন বাণিজ্য ও দখলদারির প্রতিবাদে সরব আছেন ফরিদ উদ্দিন। গত বৃহস্পতিবার গভীর রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের নবাব আবদুল লতিফ হলে এক শিক্ষার্থীকে পিটিয়ে হল ছাড়া করার প্রতিবাদে তিনি অন্য শিক্ষকদের সঙ্গে শুক্রবার সকালে ওই হলে গিয়েছিলেন। ১৩ জুন আসন বাণিজ্যের প্রতিবাদে আয়োজিত মানববন্ধনেও তিনি উপস্থিত ছিলেন। এর আগে কোটা সংস্কার আন্দোলনসহ বিভিন্ন ইস্যুতেও সরব ভূমিকা পালন করেন তিনি।
আজ সাড়ে ১১টার দিকে সরেজমিনে দেখা গেছে, অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিনের পাশে একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা ও আরেকজন শিক্ষক বসে আছেন। মাঝে একটি প্ল্যাকার্ডে হাতে লেখা, ‘শিক্ষার্থীদের ন্যায়সংগত অধিকার রক্ষায় নিপীড়ন এবং দখলদারত্ব মুক্ত শিক্ষাঙ্গনের দাবিতে প্রতীকী অনশন’।
কর্মসূচিতে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সালেহ হাসান নকীব, আরবি বিভাগের অধ্যাপক ইফতিখারুল আলম মাসউদ, বীর মুক্তিযোদ্ধা ও সাংবাদিক মাহমুদ জামাল কাদেরী সমর্থন জানিয়েছে কিছুক্ষণ বসেন। এ ছাড়া কয়েকজন শিক্ষার্থীও প্রতীকী অনশনে অংশ নেন।
অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন বলেন, ক্যাম্পাসে দখলদারি ও হলে নির্যাতনের প্রতিবাদে আগে মানববন্ধন করেছিলেন তাঁরা। তারই ধারাবাহিকতায় আজ প্রতীকী অনশনে বসেছেন। তাঁর সঙ্গে বীর মুক্তিযোদ্ধা, শিক্ষক, শিক্ষার্থীও সমর্থন জানিয়ে অবস্থান নিয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসমাজ বাংলাদেশের অভ্যুদয় থেকে আন্দোলন সংগ্রামে ছিলেন। আজ শিক্ষার্থীদের কর্মকাণ্ডে তাঁদের সেই মর্যাদাপূর্ণ অবস্থান কিছুটা হলেও ক্ষুণ্ন হয়েছে। সাধারণ শিক্ষার্থীরা নানাভাবে নির্যাতন, নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন। তাঁদের মধ্যরাতে হল থেকে বের করে দেওয়া হচ্ছে। এটি কোনো সভ্য সমাজে মেনে নেওয়া যায় না। তাঁর বিশ্বাস, পৃথিবীর কোনো রাষ্ট্রে এ ধরনের ঘটনা ঘটে না।
ফরিদ উদ্দিন আরও বলেন, হলে ছাত্র নির্যাতনের বিষয়ে হল প্রশাসনের সঙ্গেও কথা বলেছেন তিনি। তারা একধরনের অসহায় অবস্থানে রয়েছে। তিনি জানেন না, কোথায় তাদের অসহায়ত্ব। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো জায়গায় কোনো ইস্যুতে প্রশাসন যদি অসহায়ত্ব বোধ করে, এটা দুঃখজনক। তিনি বিষয়টি নিয়ে শিক্ষক সমাজের বিভিন্ন প্রতিনিধিদের সঙ্গেও কথা বলেন। তাঁরা এ বিষয়ে সরাসরি কথা না বললেও লজ্জিত। সচেতন শিক্ষক-শিক্ষার্থী-অভিভাবকেরা চান না ক্যাম্পাসে এ ধরনের কর্মকাণ্ড চলুক।
প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রীর উদ্দেশে শিক্ষাঙ্গনে চলা এই নৈরাজ্য বন্ধের আহ্বান জানিয়ে ফরিদ উদ্দিন বলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কী ধরনের নৈরাজ্য চলছে, তাঁরা নিশ্চয় সংবাদপত্রের মাধ্যমে জেনে থাকবেন। তাঁদের এ বিষয়ে গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করা উচিত। এই নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে দেশের ছাত্রসমাজ যদি রুখে দাঁড়ায়, কোনো শক্তি নেই যে টিকে থাকবে। এই ঘটনার দ্রুত সমাধান না হলে তাঁরা আন্দোলন চালিয়ে যাবেন।
বীর মুক্তিযোদ্ধা ও সাংবাদিক মাহমুদ জামাল কাদেরী বলেন, যেকোনো অন্যায়ের প্রতিবাদ করার নৈতিক দায়িত্ব আছে একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার। এই দায়িত্ব নিয়েই একাত্তরে তাঁরা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে মনে করেন, যেখানেই অন্যায়, সেখানেই প্রতিবাদ করা দরকার। তারই অংশ হিসেবে তিনি সমর্থন জানিয়ে অবস্থান নিয়েছেন।
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা যায়, ছাত্রলীগের মাধ্যমে হলে একের পর এক শিক্ষার্থী নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে। এসব ঘটনায় আবাসিক শিক্ষার্থীদের ভয়ভীতি দেখিয়ে, মারধর করে হল থেকে বের করে দেওয়া হয়। হলে হলে আসন বাণিজ্যের মতো অভিযোগও আছে। এমনকি ছাত্রলীগের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের নির্যাতনের পাশাপাশি হল প্রাধ্যক্ষেরাও লাঞ্ছিত হচ্ছেন।
শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা বলেন, করোনার পর গত বছরের ১৭ অক্টোবর হল খোলার পর ছাত্রলীগ শুরুতে আসন দখলের জন্য হলে তালা মারতে শুরু করে। এরপর বৈধভাবে হলে ওঠা শিক্ষার্থীদের নানা কায়দায় হল ছাড়া করে। আসন দখল করে তা বিক্রিরও অভিযোগ আছে। এসব ঘটনার শিকার শিক্ষার্থীরা খুব কমই প্রকাশ করেন। ছাত্রলীগের নির্যাতনের ভয়ে তাঁরা নীরবে হল ত্যাগ করেন। গণমাধ্যমে যা এসেছে, তা ছিটেফোঁটা, আসল তথ্য আরও ভয়াবহ। এসব ঘটনায় সবশেষ নবাব আবদুল লতিফ হল থেকে এক ছাত্রলীগ কর্মীকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছে। আর দুই নেতাকে হল ত্যাগের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।