নিতাইগঞ্জে বস্তাপ্রতি লবণের দাম বেড়েছে ১০০ টাকা

দেশের বিভিন্ন এলাকায় লবণ পাঠানো হয় নারায়ণগঞ্জের নিতাইগঞ্জ থেকে। দোকানে পৌঁছে দেওয়ার জন্য মিল থেকে লবণ নেওয়া হচ্ছে। নারায়ণগঞ্জের নিতাইগঞ্জ এলাকায়ছবি: দিনার মাহমুদ

নারায়ণগঞ্জ শহরের পাইকারি ব্যবসাকেন্দ্র নিতাইগঞ্জে লবণের দাম ঊর্ধ্বমুখী। গত ১৫ দিনের ব্যবধানে ৭৪ কেজি ওজনের বস্তাপ্রতি পরিশোধিত (আয়োডিনবিহীন) লবণের দাম বেড়েছে ১০০ টাকা। পরিশোধিত (আয়োডিনযুক্ত) খাওয়ার লবণ ২৫ কেজি ওজনের বস্তাপ্রতি দাম বেড়েছে ৫০ টাকার বেশি।

মূল্যবৃদ্ধির বিষয়ে ব্যবসায়ীরা দাবি করেছেন, দেশীয় লবণ উৎপাদনে ভ্যাট বসানো, লবণচাষিদের সিন্ডিকেট ও আবহাওয়ার সমস্যার কারণে লবণের দাম বেড়েছে। পবিত্র ঈদুল আজহার আগে কোরবানির পশুর চামড়া সংরক্ষণে লবণের চাহিদা যখন বাড়বে, তখন দাম আরও বাড়তে পারে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। এদিকে লবণের দাম বেড়ে যাওয়ায় রপ্তানিমুখী পোশাক উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন শিল্পকারখানার মালিকেরা।

গত বৃহস্পতিবার ও আজ শনিবার সরেজমিনে দেশের আটা-ময়দা, তেল, চিনি, লবণ, ডাল, ভোজ্য তেলের বৃহত্তম পাইকারি ব্যবসাকেন্দ্র নিতাইগঞ্জ ঘুরে লবণ ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে এই তথ্য পাওয়া গেছে।

বাজার ঘুরে দেখা গেছে, ডাইং কারখানায় ও গবাদিপশুর খাওয়ানোর জন্য আয়োডিনবিহীন সাদা লবণ ৭৪ কেজি ওজনের প্রতি বস্তা বিক্রি হচ্ছে ৭০০ টাকায়। ১৫ দিন আগে ছিল এর দাম ছিল ৫৬০ টাকা। খাওয়ার আয়োডিনযুক্ত কনফিডেন্স লবণের ২৫ কেজির বস্তা এখন ৬২০ টাকা, আগে ছিল ৫৯০ টাকা। ফুলকপি সুপার সল্ট আগে ৪৮০ টাকা ছিল, সেটি এখন ৫২০ টাকা। ফুলকপি মোটা লবণ আগে ২৮০ টাকা ছিল, সেটি এখন ৩০০ টাকা। এসিআই পিওর সল্ট ৬৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, আগে ছিল ৬২০ টাকা। মোল্লা সুপার সল্ট এখন ৬১০ টাকা, আগে ছিল ৫৮০ টাকা। তীর এখন ৫০০ টাকা, আগে ছিল ৪৭০ টাকা।

মুন্সিগঞ্জের রিকাবী বাজার থেকে আসা ক্রেতা আমিনুল ইসলাম বলেন, খাওয়ার চিকন লবণ পাইকারি ২৫ কেজির প্রতি বস্তা ৪০ টাকা বেশি দামে কিনতে হয়েছে। গবাদিপশুর খাওয়ানোর লবণ ৭৪ কেজির প্রতি বস্তা ১২০ টাকা বেশি দিয়ে কিনতে হয়েছে। খুচরা পর্যায়ে তাঁদের দাম বাড়িয়ে বিক্রি করতে হবে।

কুমিল্লার ব্যবসায়ী লোকমান হোসেনের অভিযোগ, সিন্ডিকেট করে হঠাৎ লবণের দাম বাড়ানো হয়েছে। ঈদুল আজহার অজুহাতে কোরবানির পশুর চামড়া সংরক্ষণে লবণের দাম আরও বাড়াবেন ব্যবসায়ীরা।

ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, নিতাইগঞ্জ থেকে লবণ রাজধানীর পুরান ঢাকা, উত্তরা, নরসিংদী, গাজীপুর, টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ, ফেনী, কুমিল্লা, চাঁদপুর, মুন্সিগঞ্জ, ভৈরবসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় সরবরাহ করা হয়। আগে দেশের আরও অনেক জেলায় লবণ সরবরাহ করা হতো। কিন্তু দেশের বিভিন্ন স্থানে নতুন করে মোকাম গড়ে ওঠায় এবং সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির কারণে ব্যবসায়ীরা সরাসরি চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার থেকে লবণ কিনে নেওয়ায় নিতাইগঞ্জে লবণের চাহিদা কমেছে। এসব কারণে অনেক লবণ মিল বন্ধ হয়ে গেছে।

লবণের মূল্যবৃদ্ধি প্রসঙ্গে ব্যবসায়ীদের ভাষ্য, কক্সবাজার, টেকনাফ, ইসলামপুর, পটিয়া, কুতুবদিয়া অঞ্চলের লবণচাষিদের উৎপাদিত লবণ মজুত করায় লবণের দাম বাড়ছে। এ বছর লবণের উৎপাদন ভালো হলেও চাষিরা ও চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীরা লবণ কম ছাড়ায় বাজার দর বাড়ছে।

গরিবে নেওয়াজ সল্ট ইন্ডাস্ট্রিজের মালিক জামাল উদ্দিন অভিযোগ করেন, দেশীয় লবণের উৎপাদন ভালো হলেও চাষিদের কারণে লবণের দাম বেড়েছে। বৃষ্টি বেড়েছে এবং দেশীয় লবণ উৎপাদনে ভ্যাট বসানোর কারণে চাষিরা অপরিশোধিত লবণের দাম বাড়িয়েছেন। বেশি দামে অপরিশোধিত লবণ কেনা, পরিবহন ব্যয়, লোড-আনলোড ও মিলে ক্রাসিং করতে গিয়ে উৎপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে।

এম আর ভুঁইয়া সল্ট ইন্ডাস্ট্রিজের মালিক দিলীপ রায় প্রথম আলোকে বলেন, আবহাওয়ার সমস্যা ও লবণ মজুত করে রাখার কারণে দাম বাড়ছে। চট্টগ্রামের বড় ব্যবসায়ীরা লবণ মজুত করে রেখেছেন। তাঁদের কারণে বাজারে লবণের দাম বাড়ছে। তাঁদের মিলে প্রতিদিন দুই হাজার ও তিন হাজার বস্তা (৭৪ কেজি) লবণ ক্রাসিং করা হতো। এখন তা কমে অর্ধেকে নেমেছে। ক্রেতারা এখন সরাসরি কক্সবাজার ও চট্টগ্রামে চলে যাচ্ছেন। এ কারণে বেচাকেনা কম। প্রতিদিন ১০০ থেকে ১৫০ বস্তা লবণ বিক্রি হচ্ছে।

তবে নারায়ণগঞ্জ সল্ট ইন্ডাস্ট্রিজের ব্যবস্থাপক শ্যামল সরকার দাবি করেন, তাঁদের মিল তিন বছর ধরে বন্ধ। তিন বছর আগে বেশি দামে অপরিশোধিত লবণ কিনে ক্রাসিং করেছেন। এখন লবণের দাম কমে যাওয়ায় তাঁদের লোকসান গুনতে হচ্ছে। তাঁদের মিলে ২০ হাজার বস্তা লবণ মজুত হয়ে আছে। তিনি দাবি করেন, লবণের বাজার যেভাবে বাড়ার কথা ছিল, সেভাবে বাড়েনি।

লবণ মিল মালিক সমিতির নারায়ণগঞ্জ জেলার সাধারণ সম্পাদক মাঈন উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, লবণ উৎপাদন করতে যে পরিমাণ খরচ, সেই অনুযায়ী চাষিরা দাম পাচ্ছেন না। এ কারণে লবণচাষিদের লোকসান গুনতে হচ্ছে। বাজারে দাম তাই বাড়তির দিকে। আগামী দু-তিন মাস বাজার ঊর্ধ্বমুখী থাকতে পারে, পরে আবার স্বাভাবিক হয়ে যাবে। তিনি বলেন, জেলায় ৪৪টি লবণ মিল আছে, এর মধ্যে ৬টি চালু আছে।

এদিকে নিট পোশাক কারখানার মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি মোহাম্মদ হাতেম প্রথম আলোকে বলেন, আগে ভারত ও চীন থেকে শিল্প লবণ আমদানিতে ডিউটি ফি ছিল ১৫ শতাংশ। সেটি বাড়িয়ে সরকার ২৫ শতাংশ করেছে। ডাইং ও ইটিপি পরিচালনায় লবণ ব্যবহৃত হয়। দেশীয় লবণের দাম বেড়ে যাওয়ায় উৎপাদন খরচ বাড়বে এবং পরিবেশদূষণ রক্ষায় ইটিপি পরিচালনা খরচ বেড়ে যাবে। হঠাৎ উৎপাদন খরচ বাড়লে এর প্রভাব পড়বে রপ্তানিতে। আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা কঠিন হবে।