‘নিখোঁজ’ ইলিয়াস আলী ফিরে আসবেন—এই চাওয়া স্বজনদের
বিএনপি নেতা এম ইলিয়াস আলীর সঙ্গে ‘নিখোঁজ’ হন তাঁর গাড়িচালক সিলেটের বিশ্বনাথের আনসার আলী। বড় একটি পোস্টারে আনসার আলীর ছবি নিয়ে মানববন্ধনের এক কোণে পাশাপাশি দাঁড়িয়েছিলেন মা ও মেয়ে। মানববন্ধন শেষে কথা বলতে চাইলে আনসার আলীর কিশোরী মেয়ে মহিয়া মেহজাবিন বোরকা দিয়ে চোখ আড়াল করতে চাইছিল, ‘বাবার কথা কিছু বলো...’ ওপাশ থেকে একজন বলছিলেন। বাবা কথাটি শুনেই যেন বাকরুদ্ধ। চোখ ছলছল করা মাহিয়া শুধু বলল, ‘বাবারে ফেরত চাই, আর কিছু না।’
আনসার আলী বিএনপি নেতা এম ইলিয়াস আলীর দূরসম্পর্কের ভাতিজা। ইলিয়াস আলীর গাড়ি চালাতেন তিনি। ২০১২ সালের ১৭ এপ্রিল ঢাকার বনানী থেকে ইলিয়াস আলীর সঙ্গে গাড়িচালক আনসারও নিখোঁজ হন। সেই থেকে আনসারের পরিবারের সদস্যরা ইলিয়াস আলীর সন্ধানের অপেক্ষায় আছেন।
সোমবার ‘গুমের শিকার ব্যক্তিদের স্মরণে আন্তর্জাতিক দিবস’ উপলক্ষে সিলেটে ‘মায়ের ডাক ও হিউম্যান রাইটস ডিফেন্ডারস নেটওয়ার্ক’ আয়োজিত মানববন্ধনে অংশ নেয় আনসার আলীর মেয়ে মাহিয়া ও তার মা মুক্তা বেগম। সোমবার দুপুরে সিলেট নগরীর সুবিদবাজার এলাকায় সিলেট প্রেসক্লাবের সামনে এই মানববন্ধন হয়।
মানববন্ধন চলাকালে সিলেট জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি এমাদ উল্লাহ শহিদুল ইসলামের সভাপতিত্বে সংহতি সমাবেশ হয়। এতে গুম হওয়া ব্যক্তিদের ফিরিয়ে দেওয়ার দাবির পক্ষে ‘গুম দিবসের ঘোষণাপত্র’ পাঠ করেন মায়ের ডাক ও হিউম্যান রাইটস ডিফেন্ডারস নেটওয়ার্ক সিলেটের সমন্বয়ক মুহিবুর রহমান।
ঘোষণাপত্রে বলা হয়, ‘গুম একটি মানবতাবিরোধী অপরাধ, যা মৌলিক মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন। এটি আন্তর্জাতিক অপরাধ হিসেবেও স্বীকৃত। গুম রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের একটি বড় হাতিয়ার। বাংলাদেশ সরকার এখনো গুমসংক্রান্ত আন্তর্জাতিক সনদে অনুস্বাক্ষর করেনি এবং সরকারের পক্ষ থেকে প্রতিনিয়ত গুমের বিষয়টি অস্বীকার করা হচ্ছে। অথচ জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলের ওয়ার্কিং গ্রুপ অন অ্যানফোর্সড অর ইনভলান্টারি ডিজঅ্যাপিয়ারেন্স সম্প্রতি গুম হওয়া ৩৪ জনের অবস্থান ও ভাগ্য জানতে চেয়ে বাংলাদেশ সরকারকে চিঠি দিয়েছে।’
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে ঘোষণাপত্রে বলা হয়, ‘বাংলাদেশে গুমের শিকার ৮৬ ব্যক্তি এখনো নিখোঁজ রয়েছেন বলে জানিয়ে এই ঘটনাগুলোর আন্তর্জাতিক তদন্ত করতে বলা হয়েছে। যদিও হিউম্যান রাইটস ওয়াচের প্রতিবেদনে প্রকাশিত সংখ্যার চেয়ে গুম হয়ে যাওয়া ব্যক্তিদের সংখ্যা অনেক বেশি। মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের তথ্য অনুযায়ী ২০০৯ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২০২১ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত বাংলাদেশে ৬০৩ জন গুমের শিকার হয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।’
গুমের পাশাপাশি চলছে ব্যাপকভাবে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও হেফাজতে নির্যাতন করে হত্যার ঘটনা ঘটছে অভিযোগ তুলে ঘোষণাপত্রে আরও বলা হয়, ‘গুম হওয়া ব্যক্তিরাও নির্যাতন ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হচ্ছেন। এ ছাড়া গুম হয়ে যাওয়া ব্যক্তিদের স্ত্রী-সন্তানেরাও আর্থিক ও সামাজিকভাবে তাঁদের অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়ে চরম কষ্টে রয়েছেন। জনগণের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা না হওয়ায় এই ভয়াবহ ঘটনাগুলো ঘটেই চলেছে। তাই জনসমর্থিত একটি ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা এবং সব ধরনের অন্যায়-অবিচারের প্রতিকার করতে ভুক্তভোগী পরিবারগুলোকে সঙ্গে নিয়ে বাংলাদেশের জনগণকে এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই।’
গুম হওয়া ব্যক্তিদের ফিরিয়ে দেওয়ার দাবিতে সংহতি জনিয়ে বক্তব্য দেন সিলেট প্রেসক্লাবের সভাপতি ইকবাল সিদ্দিকী, সাবেক সহসভাপতি আবদুল কাদের তাপাদার, সাংবাদিক হুমায়ূন রশিদ চৌধুরী, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিলের সংগঠক মিনহাজ তুষার, মানবাধিকারকর্মী চৌধুরী দেলওয়ার হোসেন, মানব চ্যাটার্জি, আমিন তাহমীদ, আলী আহসান প্রমুখ। তাঁরা সিলেটে এম ইলিয়াস আলী ও তাঁর গাড়িচালক আনসার আলী ছাড়াও ২০১২ সালের ৪ এপ্রিল থেকে ‘নিখোঁজ’ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল নেতা ইফতেখার আহমদ দিনার ও জুনেদ আহমদ এবং ২০০৪ সালে ‘গুম’ হওয়া সিলেট শহরের ব্যবসায়ী হাবিবুর রহমানের সন্ধান দাবি করেন।
মানববন্ধন শেষে ইলিয়াস আলীর গাড়িচালক আনসার আলীর স্ত্রী মুক্তা বেগমের সঙ্গে কথা হয়। ২০১২ সালের ১৭ এপ্রিল ইলিয়াস আলীর সঙ্গে সিলেট থেকে ঢাকায় যান আনসার আলী। রাতে নিখোঁজ হওয়ার কিছুক্ষণ আগে স্ত্রী মুক্তা বেগমের কাছে ফোন করেছিলেন। মুক্তা বেগম প্রথম আলোকে বলেন, ‘ফোন করে ঢাকায় পৌঁছার কথা জানিয়েছিলেন তিনি। ইলিয়াস আলীর সঙ্গে আছেন জানিয়ে বলেছিলেন বাসায় গিয়ে ফোন দেবেন। মাত্র ৫০ সেকেন্ডের সেই ফোন কলটি ছিল তাঁর সঙ্গে শেষ কথা। এখনো আশায় আছি, একটি ফোন পাব, তাঁকে ফিরে পাব। এ ছাড়া আমরার আর কোনো সান্ত্বনা নাই।’
আনসার আলীর একমাত্র মেয়ে মাহিয়া মেহজাবিনের কথা বলতে গিয়ে আপ্লুত হয়ে পড়েন মুক্তা বেগম। তিনি জানান, তাঁর কাছে স্বামীর স্মৃতি বলতে তিন-চার বছরের সংসারজীবন। ২০০৮ সালে পারিবারিকভাবে তাঁদের বিয়ে হয়েছিল। তাঁদের একমাত্র মেয়ে মাহিয়া মেহজাবিন এখন ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ছে। মেয়েটির বয়স যখন তিন বছর, তখন আনসার আলী নিখোঁজ হন। মুক্তা বলেন, ‘মেয়ের স্মৃতিতে তার বাবা পোস্টারের ছবি। বাবা কই জানতে চাইলে কোনো কিছু না বলে শুধু ছবিটি দেখায়। নীরবে কাঁদে।’
নিখোঁজ হওয়ার আগে এম ইলিয়াস আলী বিএনপির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্বে ছিলেন। সিলেট জেলা বিএনপির সাবেক আহ্বায়ক ও সিলেট-২ আসনের সাবেক সাংসদ ছিলেন তিনি। সিলেটে এম ইলিয়াস আলীর ব্যক্তিগত কর্মকর্তার (পিএস) দায়িত্ব পালন করতেন জেলা বিএনপির সাবেক দপ্তর সম্পাদক মো. ময়নুল হক। ইলিয়াস আলীর একটি পোস্টার নিয়ে তিনিও মানববন্ধনে অংশ নেন।
ময়নুল প্রথম আলোকে বলেন, ‘যে যাই বলুক, একমুহূর্তের জন্যও মনে হয় না তিনি (ইলিয়াস আলী) নেই। তাই আমরা তাঁর ফেরার আশা কোনোভাবেই ছাড়ছি না। যেখানেই যেভাবে গুম হওয়া মানুষের পক্ষে দাবি ওঠে, সেখানে অংশ নিয়ে আমরা একটি দাবিই জানাই, ইলিয়াস আলীসহ গুম হওয়া সবার সন্ধান চাই। ইলিয়াস আলী গুম হয়ে আছেন, সন্ধান চাই—এই চাওয়া আমাদের আজীবনের।’