নাসিরনগরে বসেছে বিনিময় প্রথার শুঁটকি মেলা
প্রাচীনকালের পণ্য বিনিময় প্রথা কেমন ছিল, তার কিছুটা হলেও আঁচ পাওয়া যায় মেলাটিতে গেলে। এখানে অন্যান্য পণ্যের বিনিময়ে পাওয়া যায় শুঁটকি। শত বছরের ঐতিহ্য ধারণ করে প্রতিবছর মেলাটি বসে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর উপজেলার কুলিকুন্ডা গ্রামে। করোনার কারণে দুই বছরের বিরতি শেষে আবারও বসেছে ব্যতিক্রমী এই মেলা। এতে শুঁটকিপ্রেমীদের ভিড় নেমেছে। মেলায় পাওয়া যাচ্ছে নানা জাতের মাছের শুঁটকি। কেনাবেচা হচ্ছে অন্যান্য পণ্যও।
বাংলা পঞ্জিকার নিয়মানুযায়ী, নববর্ষের দ্বিতীয় দিনে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের পয়লা বৈশাখ উপলক্ষে নিয়মিতভাবে প্রতিবছর এই মেলা বসে। স্থানীয় জেলেরা পূর্বপুরুষের ঐতিহ্য ধরে রাখতেই ব্যতিক্রমী এ মেলা করে থাকে। কুলিকুন্ডা গ্রামের কুলিকুন্ডা (উওর) সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠে শুক্রবার থেকে শুরু হওয়া এ মেলা চলবে আগামীকাল শনিবার পর্যন্ত।
গ্রামবাসী ও মেলায় আসা একাধিক ব্যক্তি বলেন, কবে মেলার প্রথম আয়োজন তা জানা না গেলেও প্রতিবছরই এই মেলা বসে। কেউ বলেন এই শুঁটকি মেলা প্রায় চার শ বছরের পুরোনো। কেউ বলেন, দুই শ বছরের পুরোনো। আবার কারও কারও ধারণা, তিন শ বা পাঁচ শ বছরের পুরোনো এই মেলা। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে শুঁটকি ব্যবসায়ী ছাড়াও ভোজনরসিকেরা আসেন এ মেলায়।
শুক্রবার সকালে মেলায় গ্রামের লোকজন ও দোকানিদের মধ্যে চলে এ পণ্যের বিনিময়ে পণ্য বিনিময়ের প্রথা। কিন্তু সেটি ঐতিহ্য রক্ষায় স্বল্প সময়ের জন্য। স্থানীয় কৃষকেরা তাঁদের উৎপাদিত চাল, ডাল, ধান, শিমের বিচি, আলু, শর্ষে, পেঁয়াজ, রসুনসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় নানা পণ্যের বিনিময়ে শুঁটকি কিনে নেন। বিনিময় প্রথার পাশাপাশি টাকা দিয়েও শুঁটকি কেনা যায়। মেলায় শুঁটকির পাশাপাশি গৃহস্থালিসামগ্রীসহ শিশুদের নানা ধরনের খেলনাও বিক্রি হয়।
মেলায় আগত ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শুধু স্থানীয় লোকজন নয়, সিলেট, হবিগঞ্জ, আশুগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, ভৈরবসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে ব্যবসায়ীরা এই মেলায় এসেছেন। মেলায় বোয়াল, গজার, শোল, বাইম, ছুরি, লইট্টা, পুঁটি, গনা, গুচি, ট্যাংরা, আইড়সহ আড়াই শর বেশি ধরনের শুঁটকির পসরা নিয়ে বসেছেন দোকানিরা। এ ছাড়া মেলায় ইলিশ ও সামুদ্রিক নানা বিরল জাতের মাছের শুঁটকি রয়েছে। শুঁটকি ছাড়াও ইলিশ ও কার্পজাতীয় বিভিন্ন মাছের ডিমও রয়েছে দোকানিদের পসরায়। মেলায় স্থানীয় কুমারদের হাতের তৈরি হাঁড়ি, পাতিল, কলসি, ঝাঁজর, থালা, ঘটি, বদনা, বাটি, পুতুলসহ নানা ধরনের সামগ্রী আছে।
মেলায় পণ্য নিয়ে আসা ভগবতী রানী দাস বলেন, ‘এই প্রথম শুঁটকি নিয়ে মেলায় এসেছি। অনেকে আমার কাছ থেকে ডাল, আলু, মরিচ, শিমের বিচি, কাঁচা আম দিয়ে শুঁটকি নিয়েছে। এটি আমার কাছে ভালো লেগেছে।’ ৩০ বছর ধরে এই মেলায় কলিকুন্ডা গ্রামের রেনু মিয়া বলেন, তিনি আলু, ডাল, শিমের বিচি, শর্ষে ইত্যাদির বিনিময়ে শুঁটকি নিয়েছেন।
নাসিরনগর সদর ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক সদস্য বিশ্বাস আলী বলেন, একসময় এ অঞ্চলে হিন্দু সম্প্রদায়ের জেলেদের বসবাস ছিল। তখন কাগজের মুদ্রার প্রচলন ছিল না। এ অঞ্চলের জেলেরা নিজেদের উৎপাদিত শুঁটকি নানা ফসলের বিনিময়ে সাধারণ মানুষের কাছে বিক্রি করতেন। সেই প্রথা থেকে এই শুঁটকি মেলা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। এই মেলার বয়স তিন-চার শ বছরের কম হবে না।
মেলা পরিচালনা কমিটির সভাপতি ওহাব আলী জানান, এই মেলায় হিন্দু–মুসলমানের মধ্যে কোনো ভেদাভেদ নেই। মেলায় পণ্য ও শুঁটকির বিনিময় হয়। পাঁচ একর এলাকাজুড়ে বসেছে মেলা। করোনার কারণে গত দুই বছর মেলা বসেনি। এবার মেলা বসায় সবাই আনন্দিত। ভালো বেচাকেনা হচ্ছে। ভালো ব্যবসা হচ্ছে।