নাগরিক দুর্ভোগে জর্জরিত হবিগঞ্জ পৌরসভা
হবিগঞ্জ ‘এ’ শ্রেণিভুক্ত পৌরসভা হলেও এখানে নাগরিক দুর্ভোগ চরম আকার ধারণ করেছে। ভাঙাচোরা ও অপ্রশস্ত রাস্তাঘাট, অপরিচ্ছন্নতা, জলাবদ্ধতা, অপর্যাপ্ত ড্রেনেজ (নর্দমা) ব্যবস্থা, সুপেয় পানির সংকট আর মশার উপদ্রব—দিনের পর দিন এসব সমস্যা জিইয়ে আছে জানিয়ে শহরের একাধিক বাসিন্দা ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।
‘হবিগঞ্জ পৌর শহরের প্রধান সমস্যা কী?’
এমন প্রশ্ন গোটা বিশেক পথচলতি মানুষকে জিজ্ঞেস করলে প্রায় সবাই একই উত্তর দেন। তাঁদের উত্তরের সারসংক্ষেপ করলে শহরের নাগরিক দুর্ভোগের তালিকাটা এ রকমই দাঁড়ায়: ভাঙাচোরা ও অপ্রশস্ত রাস্তাঘাট, অপরিচ্ছন্নতা, জলাবদ্ধতা, অপর্যাপ্ত ড্রেনেজ (নর্দমা) ব্যবস্থা, সুপেয় পানির সংকট আর মশার উপদ্রব। দিনের পর দিন এসব সমস্যা জিইয়ে আছে জানিয়ে শহরের একাধিক বাসিন্দা ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।
শহরে ময়লা ফেলার জন্য কোনো ডাম্পিং স্টেশন (ভাগাড়) নেই। এ অবস্থায় আধুনিক স্টেডিয়ামের পাশে মূল সড়কের উভয় পাশে শহরের যাবতীয় ময়লা-আবর্জনা ফেলে রাখা হচ্ছে। সেখানে স্তূপাকারে পড়ে থাকা বর্জ্যের দুর্গন্ধ সহ্য করে পথচারী ও স্টেডিয়ামগামী কিশোর-তরুণদের যেতে হচ্ছে।হবিগঞ্জ পৌর শহরের একাধিক বাসিন্দা
‘কিন্তু সমাধান হচ্ছে না কেন?’ উত্তরে ভুক্তভোগীদের ভাষ্য, ‘সেটা না হয় পৌর মেয়রকেই জিজ্ঞেস করুন।’
এসব সমস্যা ও সংকটের বিষয়ে জানতে চাইলে মেয়র মো. মিজানুর রহমান বলেন, ‘এক বছরের কিছুটা বেশি সময় হলো উপনির্বাচনে জয়ী হয়ে দায়িত্ব নিয়েছি। অল্প সময়েই শহরে অনেক ইতিবাচক পরিবর্তন এনেছি। দীর্ঘদিনের সমস্যাগুলো দূর করতে আন্তরিকভাবে চেষ্টা করছি। অচল ড্রেন সচলের পাশাপাশি দুটি খাল উদ্ধার ও নতুনভাবে ড্রেন তৈরি করার ফলে এরই মধ্যে শহরের জলাবদ্ধতা ৯০ শতাংশ দূর করতে পেরেছি। মশার উপদ্রবও নেই বললে চলে। শহর পরিচ্ছন্ন রাখতে নিয়মিত বর্জ্য অপসারণ করা হচ্ছে।’
শহরে কোনো পার্ক নেই। এতে শিশু-কিশোরেরা সঠিক ও সাবলীলভাবে বেড়ে উঠতে পারছে না। হাঁটার জন্য নেই কোনো ফুটপাত। খেলার মাঠ, পুকুর ও দিঘি ভরাট হয়ে বহুতল ভবন হচ্ছে। ক্রমে বাণিজ্যিক হয়ে ওঠা এ শহর শিশু-কিশোরদের জন্য অনুপযোগী এক শহরে পরিণত হচ্ছে।রুমা মোদক, হবিগঞ্জ পৌর শহরের বাসিন্দা, কথাসাহিত্যিক ও নাট্যকার
পৌর কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ১৮৮১ সালে পৌরসভাটি গঠিত হয়। ৯ দশমিক শূন্য ৫ বর্গকিলোমিটার আয়তনের ‘এ’ শ্রেণির এ পৌরসভার মোট বাসিন্দা প্রায় এক লাখ। পৌরসভায় মোট ১৪৫ কিলোমিটার রাস্তা রয়েছে। ড্রেন রয়েছে পাকা ৬৫ কিলোমিটার ও কাঁচা ১৫ কিলোমিটার। রাস্তায় সড়কবাতি রয়েছে ১ হাজার ৮৫০ টি। ৯টি ওয়ার্ডের ৭৩টি মহল্লায় মোট পরিবারের সংখ্যা ১৩ হাজার ৫১৭। শিক্ষার হার ৬৬ দশমিক ১২ শতাংশ। ১০ লাখ গ্যালন পানির চাহিদার বিপরীতে তারা পানি সরবরাহ করতে পারছে ৬ লাখ গ্যালন।
গত সোমবার সরেজমিনে দেখা গেছে, শহরের পিটিআই, শ্মশানঘাট, রেড ক্রিসেন্ট, টাউন হল, কালীবাড়ি, সবুজবাগ, পইল রোড, কিবরিয়া ব্রিজ সড়ক, বেবিস্ট্যান্ড, পুরাতন পৌরসভা রোডসহ বিভিন্ন এলাকার সড়কে ইটের খোয়া উঠে ছোট-বড় অসংখ্য খানাখন্দ তৈরি হয়েছে। কোথাও কোথাও বৃষ্টির পানি জমে জলকাদা তৈরি হয়েছে। সেসব সড়ক দিয়ে যাওয়ার সময় যাত্রী ও পথচারীদের চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয়। ভাঙাচোরা সড়কের পাশাপাশি শহরের পাড়া-মহল্লায় সরু রাস্তাঘাটও দেখা গেছে।
হবিগঞ্জ পৌর শহরে ১০ লাখ গ্যালন পানির চাহিদার বিপরীতে পৌর কর্তৃপক্ষ পানি সরবরাহ করতে পারছে ৬ লাখ গ্যালন।
পিটিআই এলাকার ব্যবসায়ী আহমেদ আতিকুর রহমান (৪২) জানান, দেড় বছর ধরে তাঁর এলাকার সড়কটি ভাঙাচোরা। বিশাল বিশাল গর্তে প্রায়ই রিকশা উল্টে দুর্ঘটনা ঘটে। এ ছাড়া ভোগান্তি তো আছেই। শ্মশানঘাট এলাকার ব্যবসায়ী প্রাণকৃষ্ণ সরকার (৩৯) জানান, সংস্কারের অভাবে সড়কের গর্ত দিনে দিনে বৃহৎ হচ্ছে। সামান্য বৃষ্টি হলেই সড়কের গর্ত ছোট পুকুরের মতো রূপ নেয়। বিষয়টি মেয়রকে জানানো হয়েছে।
শহরের রাস্তায় যত্রতত্র ময়লা-আবর্জনা পড়ে থাকার বিষয়টি অত্যন্ত দৃষ্টিকটু ও জনস্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ বলে স্থানীয় বাসিন্দারা উল্লেখ করেছেন। শহরের অন্তত ৩০টি স্থান ঘুরে যেখানে-সেখানে প্লাস্টিকের বোতল, পলিথিনসহ বিবিধ বর্জ্য উন্মুক্ত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখা গেছে। যেসব এলাকার রাস্তা ও নালা-নর্দমা বেশি অপরিচ্ছন্ন ও নোংরা দেখা গেছে, এর মধ্যে চৌধুরী বাজার, মহিলা কলেজ রোড, জেলা শিল্পকলা একাডেমির সম্মুখভাগ, মোহনপুর, শায়েস্তানগর, অনন্তপুর, নোয়াবাদ, খোয়াই নদের পাড়, কালীগাছতলা, বাইপাস রোড, কামড়াপুর, জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যালয়ের সম্মুখভাগ উল্লেখযোগ্য।
শহরের ভেতরের প্রধান একটি রাস্তা সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তরের। তাদের ভাঙাচোরা অংশ সংস্কারের অনুরোধ জানানো হয়েছে। পাশাপাশি পিটিআই, কলেজ রোডসহ পৌর কর্তৃপক্ষের অধীন থাকা যেসব সড়কে খানাখন্দ রয়েছে, তা পুনর্নির্মাণে এরই মধ্যে দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। একটি শিশুপার্ক তৈরি করার জন্য উন্মুক্ত জায়গা খোঁজা হচ্ছে। নতুন আরেকটি ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট (পানি শোধনাগার) তৈরি হচ্ছে, এতে সুপেয় পানির আর কোনো সংকট থাকবে না।মো. মিজানুর রহমান, হবিগঞ্জ পৌর মেয়র
একাধিক বাসিন্দা জানান, শহরে ময়লা ফেলার জন্য কোনো ডাম্পিং স্টেশন (ভাগাড়) নেই। এ অবস্থায় আধুনিক স্টেডিয়ামের পাশে মূল সড়কের উভয় পাশে শহরের যাবতীয় ময়লা-আবর্জনা ফেলে রাখা হচ্ছে। সেখানে স্তূপাকারে পড়ে থাকা বর্জ্যের দুর্গন্ধ সহ্য করে পথচারী ও স্টেডিয়ামগামী কিশোর-তরুণদের যেতে হচ্ছে।
পৌর কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, শহরে প্রতিদিন গড়ে ১৬ মেট্রিক টন বর্জ্য উৎপাদন হয়ে থাকে। ডাম্পিং স্টেশন তৈরির জন্য ২০১২ সালে পার্শ্ববর্তী বানিয়াচং উপজেলার আতুকুড়া এলাকায় জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছিল। কিন্তু সেখানে ডাম্পিং স্টেশন নির্মাণে আপত্তি জানান বাসিন্দারা। এ বাধার ফলে সেখানে ডাম্পিং স্টেশন নির্মাণ করা যায়নি। এখন নতুন কোনো স্থানে ডাম্পিং স্টেশন তৈরির জন্য জায়গা খোঁজা হচ্ছে। এ অবস্থায় প্রতিদিনের উৎপাদিত ময়লা স্টেডিয়ামের পাশে রাস্তার ধারে নিয়ে ফেলা হচ্ছে।
পৌর শহরের বাসিন্দা কথাসাহিত্যিক ও নাট্যকার রুমা মোদক বলেন, শহরে কোনো পার্ক নেই। এতে শিশু-কিশোরেরা সঠিক ও সাবলীলভাবে বেড়ে উঠতে পারছে না। হাঁটার জন্য নেই কোনো ফুটপাত। খেলার মাঠ, পুকুর ও দিঘি ভরাট হয়ে বহুতল ভবন হচ্ছে। ক্রমে বাণিজ্যিক হয়ে ওঠা এ শহর শিশু-কিশোরদের জন্য অনুপযোগী এক শহরে পরিণত হচ্ছে।
স্থানীয় লোকজন জানিয়েছেন, ‘এ’ শ্রেণিভুক্ত পৌরসভা হলেও এখানে নাগরিক দুর্ভোগ চরম আকার ধারণ করেছে। সন্ধ্যার পর থেকে মশার উপদ্রব আর অপর্যাপ্ত ড্রেনেজ সমস্যার কারণে জলাবদ্ধতা এখানে নিত্যসঙ্গী। শহরের শ্যামলী, সার্কিট হাউস এলাকাসহ কিছু স্থানে সামান্য বৃষ্টিপাতেই জলাবদ্ধতা দেখা দেয়। রয়েছে সড়কবাতিরও সংকট।
পৌর মেয়র মো. মিজানুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘শহরের ভেতরের প্রধান একটি রাস্তা সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তরের। তাদের ভাঙাচোরা অংশ সংস্কারের অনুরোধ জানানো হয়েছে। পাশাপাশি পিটিআই, কলেজ রোডসহ পৌর কর্তৃপক্ষের অধীন থাকা যেসব সড়কে খানাখন্দ রয়েছে, তা পুনর্নির্মাণে এরই মধ্যে দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। একটি শিশুপার্ক তৈরি করার জন্য উন্মুক্ত জায়গা খোঁজা হচ্ছে। নতুন আরেকটি ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট (পানি শোধনাগার) তৈরি হচ্ছে, এতে সুপেয় পানির আর কোনো সংকট থাকবে না।’