নতুন খাল খননে উদ্যোগ নেই
চট্টগ্রাম নগরের প্রায় অর্ধেক এলাকা বর্ষা মৌসুমে সৃষ্ট জলাবদ্ধতায় ডুবে যায়। এই সমস্যা সমাধানে তিনটি নতুন এবং ১৫টি শাখা খাল খননের সুপারিশ করা হয়েছিল ১৯৯২ সালে। কিন্তু ড্রেনেজ মহাপরিকল্পনার এই সুপারিশ গত ২৬ বছরেও বাস্তবায়ন করেনি চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন কিংবা চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ)। ফলে নগরবাসীর দুর্ভোগ থেকেই যাচ্ছে।
এসব প্রকল্প বাস্তবায়নে একসময় অর্থাভাবের কথা বলা হলেও এখন তা নেই। কেননা সরকার তিনটি প্রকল্পে ৯ হাজার ২৩৬ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে। এর মধ্যে সিডিএ বাস্তবায়ন করছে ৭ হাজার ৬১৬ কোটি টাকার দুটি প্রকল্প। আর পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) ১ হাজার ৬২০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প গত ২৭ ফেব্রুয়ারি অনুমোদন দেওয়া হয়।
এসব প্রকল্পে নালা-নর্দমা ও খালের পুনঃখনন, বাঁধ নির্মাণ, জোয়ার প্রতিরোধক ফটক (টাইডাল রেগুলেটর), খালের দুই পাশে প্রতিরোধ দেয়াল, সেতু ও কালভার্ট নির্মাণ, বালুর ফাঁদ নির্মাণের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে। কিন্তু নতুন ও শাখা খাল খননে কোনো বরাদ্দ রাখেনি এই দুটি সংস্থা। আপাতত কোনো পরিকল্পনাও নেই। ফলে চলমান প্রকল্পগুলো বাস্তবায়িত হলে নগরবাসী কী সুফল পাবে তা নিয়ে বিশেষজ্ঞ ও সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের সংশয় আছে।
সিটি করপোরেশনের মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন প্রথম আলোকে বলেন, জলাবদ্ধতা নিরসনের ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার প্রকল্পের অনুমোদন দিয়েছেন। কিন্তু বাস্তবায়নকারী সংস্থাগুলো মহাপরিকল্পনা ও জরিপ অনুযায়ী কাজ না করলে নগরবাসী কতটুকু সুফল পাবে তা নিয়ে সন্দেহ থেকে যায়।
জানতে চাইলে সিডিএর নির্বাহী প্রকৌশলী ও প্রকল্প পরিচালক আহমদ মঈনুদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ওয়াসার মহাপরিকল্পনাকে ভিত্তি ধরে তাঁদের জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। ওখানে নতুন খাল খননের বিষয়ে কিছু বলা ছিল না। তবে সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড জিওগ্রাফিক্যাল ইনফরমেশন সার্ভিসেস (সিইজিআইএস) নামের একটি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে কাজ করছে। তারা যদি নতুন খাল খননের প্রস্তাব দেয় তাহলে তা বাস্তবায়ন করা হবে।
আর পাউবোর চট্টগ্রাম অঞ্চলের নির্বাহী প্রকৌশলী বিদ্যুৎ কুমার সাহা প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা কর্ণফুলী নদীকে কেন্দ্র করে প্রকল্প নিয়েছেন। নগরের ভেতর তাঁরা কোনো কাজ করবেন না। ওখানে কাজ করবে সিটি করপোরেশন ও সিডিএ।
ড্রেনেজ মহাপরিকল্পনায় যা ছিল
জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) আর্থিক সহায়তায় এবং জাতিসংঘের মানববসতি কর্মসূচির (ইউএনএইচসিআর) কারিগরি সহায়তায় ১৯৯২ সালে সিডিএ ‘চিটাগং স্টর্ম ওয়াটার ড্রেনেজ অ্যান্ড ফ্লাড কন্ট্রোল মাস্টারপ্ল্যান’ নামে এই মহাপরিকল্পনা তৈরি করে। ১৯৯৮ সালের ৮ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপতির আদেশক্রমে এই মহাপরিকল্পনা প্রকাশ করে প্রজ্ঞাপন জারি করে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়। ২০ বছর মেয়াদি এ মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছিল ৯০০ কোটি টাকা এবং দায়িত্ব ছিল চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের।
এই মহাপরিকল্পনায় নতুন তিনটি খাল খননের সুপারিশ করা হয়। এর মধ্যে চট্টগ্রাম নগরের বহদ্দারহাটের বারইপাড়ার চাক্তাই খাল থেকে কর্ণফুলী নদী পর্যন্ত ২ দশমিক ৯ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের একটি, নগরের ষোলশহর রেলস্টেশন থেকে বহদ্দারহাট পর্যন্ত ৫৫৪ মিটার দীর্ঘ একটি এবং নোয়াখালের সমান্তরালে রেললাইনের উত্তর পাশে ১ দশমিক ৩১ কিলোমিটার দীর্ঘ খাল খননের সুপারিশ করা হয়। ১৯৯২ সালের বাজারদর অনুযায়ী এই তিনটি খাল খননে ব্যয় ধরা হয়েছিল ২৩ কোটি টাকা। এখন এসব খাল খনন করতে গেলে প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা লাগবে বলে সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীরা জানিয়েছেন।
এ ছাড়া নগরের বিভিন্ন এলাকায় বিদ্যমান খালগুলোর সঙ্গে সংযোগ করার জন্য আরও ১৫টি শাখা খাল খননের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। নগরের সরকারি কমার্স কলেজের পাশে একটি, আমবাগান থেকে আগ্রাবাদ আবাসিক এলাকায় দুটি, গয়না ছড়া খাল থেকে মহেশ খাল পর্যন্ত একটি, শুলকবহরে একটি, ষোলশহরে একটি, উত্তর চান্দগাঁও এলাকায় তিনটি, পতেঙ্গা-হালিশহর এলাকায় চারটি এবং হাটহাজারী সড়কের পূর্ব পাশে দুটি খাল খননের কথা বলা হয়েছিল।
এর মধ্যে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন ২০১২ সালে বহদ্দারহাটের বারইপাড়া থেকে কর্ণফুলী নদী পর্যন্ত নতুন খাল খননের উদ্যোগ নিয়েছিল। কিন্তু সাত বছরেও তার কাজ শুরু করতে পারেনি। ৩২৪ কোটি টাকার এই প্রকল্পের এখন ব্যয় দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ২০০ কোটি টাকায়। তবে দুটি নতুন খাল ও শাখা খালগুলো খননের বিষয়ে এখনো পর্যন্ত কোনো সংস্থা উদ্যোগ নেয়নি।
কেন নতুন খাল খনন প্রয়োজন
নগরায়ণের কারণে চট্টগ্রাম নগরের নিচু এলাকাগুলো ভরাট করে ঘরবাড়ি নির্মাণ করা হয়েছে। ভবন ও রাস্তাঘাট নির্মাণের কারণে আচ্ছাদিত এলাকার পরিমাণ বেড়ে গেছে। ভরাটের কারণে পুকুর-জলাশয়ের সংখ্যা কমে গেছে। অবৈধ দখলের কারণে নালা-নর্দমা ও খালের প্রশস্ততা সংকুচিত হয়েছে। বসতি স্থাপনের কারণে পাহাড়ের মাটি ও বালু ক্ষয়ের পরিমাণ বেড়েছে।
এসব কারণে বর্তমানে পানিনিষ্কাশন প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এতে অল্প সময়ের ভারী বৃষ্টিপাতে নগরের বিভিন্ন এলাকায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হচ্ছে।
ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন, বাংলাদেশের (আইইবি) চট্টগ্রাম কেন্দ্রের সাবেক চেয়ারম্যান দেলোয়ার মজুমদার বলেন, নগরের বিদ্যমান নালা-নর্দমা ও খালগুলোর যে অবস্থা তাতে ভারী বৃষ্টিপাতের পানিনিষ্কাশন সম্ভব নয়। তাই মহাপরিকল্পনার সুপারিশ অনুযায়ী নতুন খালগুলো খনন করতে হবে। হাজার হাজার কোটি টাকার প্রকল্পগুলোর পুরোপুরি সুফল পেতে হলে নতুন খাল খনন এবং জলাধার স্থাপনের বিকল্প নেই।
নতুন খাল খনন ও জলাধার নির্মাণের গুরুত্ব দিয়ে এই নগর পরিকল্পনাবিদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘ড্রেনেজ মহাপরিকল্পনা প্রণয়নের জন্য ওয়াসা তিনটি মতবিনিময় সভা করেছিল।
নতুন খাল খননের প্রস্তাব না রাখায় সেসব সভায় আমি আপত্তি জানিয়েছিলাম। শুধু নতুন খাল খনন করলেই হবে না বিদ্যমান প্রধান ও শাখা খালগুলোর প্রয়োজনীয় সংস্কার করা প্রয়োজন।’