কক্সবাজার শহর থেকে প্রায় ৬৫ কিলোমিটার দক্ষিণে উখিয়া বালুখালী স্টেশন। সেখান থেকে পশ্চিম দিকে আরও পাঁচ কিলোমিটার গেলে সামনে পড়ে পাহাড়-টিলার বালুখালী রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবির। দেড় মাস আগে গত ২২ মার্চ ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে বালুখালীসহ আশপাশের তিনটি আশ্রয়শিবিরের ১০ হাজার ১৬৫টি রোহিঙ্গা বসতি পুড়ে ছাই হয়। প্রাণ যায় ১১ রোহিঙ্গার।
ঘটনার পর আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইওএম) এবং সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত ১২ হাজার ২৫২ পরিবারে মাথা গোঁজার ঠাঁই হিসেবে প্রতিটি পরিবারকে একটি ও দুটি করে ত্রিপল, তিনটি বাঁশ, থাকার জন্য একটি পাটি, একটি মশারি, হাঁড়িপাতিলসহ রান্নাবান্নার সরঞ্জাম সরবরাহ করা হয়। এরপর ধ্বংসস্তূপের ওপর তৈরি হয় ত্রিপলের ছাউনিযুক্ত ঘিঞ্জি বসতি। আর তাতেই চলছে রোহিঙ্গাদের কষ্টের জীবন।
প্রচণ্ড গরমে ত্রিপলের নিচে থাকাটা যেমন কষ্টের, তেমনি ঝড়বৃষ্টিতে কী হবে, তা নিয়ে আছে নানা শঙ্কা। রোহিঙ্গাদের দাবি, তাঁরা আগের মতো স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে চান। তাঁদের জন্য যেন স্থায়ী কিছু তৈরি করে দেওয়া হয়।
সরকারের শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) কার্যালয়ের তত্ত্বাবধানে আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত তিনটি আশ্রয়শিবিরের উন্নয়ন ও পুনর্বাসন কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে আইওএম। ধ্বংসস্তূপের ওপর স্থায়ী অবকাঠামো (শেল্টার) নির্মাণ প্রসঙ্গে আইওএমের রোহিঙ্গা সংকটে দায়িত্বপ্রাপ্ত ন্যাশনাল কমিউনিকেশন অফিসার তারেক মাহমুদ প্রথম আলোকে বলেন, তদন্ত কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী রোহিঙ্গাদের শেল্টার তৈরি হবে। নকশা অনুমোদনের কাজ সম্পন্ন হলেই শেল্টার তৈরির কাজ শুরু হবে। যদিও ইতিমধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত ১২ হাজার ২৫২ পরিবারকে ঘর তৈরির প্রয়োজনীয় ত্রিপল, বাঁশ, লোহার খুঁটিসহ প্রয়োজনীয় জিনিস সরবরাহ করা হয়েছে।
অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা তদন্তে গঠিত সাত সদস্যের কমিটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন দাখিল করে গত ২৮ মার্চ। প্রতিবেদনে বলা হয়, ২২ মার্চ বেলা সোয়া দুইটার দিকে বালুখালী-৮ ক্যাম্পের ডি-ব্লকের বাসিন্দা মৌলভি খলিলের ঘরের গ্যাস সিলিন্ডার থেকে অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত। পরে তা দ্রুত পাশের ক্যাম্প-৮ ও ক্যাম্প-৯-এ ছড়িয়ে পড়ে।
অতিরিক্ত শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মো. শামছু-দ্দৌজা প্রথম আলোকে বলেন, এখন ক্যাম্পে যা হবে, তদন্ত কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী করা হবে। বর্তমানে আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত কোনো রোহিঙ্গা পরিবার খোলা আকাশের নিচে নেই। তাঁদের পরিবারে মানবিক সহায়তাও অব্যাহত আছে।
গরমে হাঁসফাঁস, বর্ষা নিয়ে দুশ্চিন্তা
বালুখালী-৯ ক্যাম্পের ৬০ থেকে ৭০ ফুট উঁচু একটি পাহাড়ে শতাধিক রোহিঙ্গা পরিবার নিয়ে সি-৩ ব্লক। সেখানে একটি ত্রিপলের ছাউনিতে বসতি রোহিঙ্গা জাফর আলমের। সম্প্রতি সেখানে গিয়ে কথা হয় জাফর আলম ও তাঁর স্ত্রী ছেনুয়ারা বেগমের সঙ্গে।
ত্রিপলের নিচে তিন ছেলে ও এক স্বজনকে নিয়ে আছেন তাঁরা। কেমন কাটছে জীবন?—জবাবে ছেনুয়ারা বেগম বলেন, ত্রিপলের নিচে আপাতত মাথা গোঁজার ঠাঁই হলেও ভোগান্তির যেন শেষ নেই। ঘরের সঙ্গে লাগোয়া টয়লেট, গোসলখানা পুড়ে শেষ। এখন পাহাড়ের ওপর থেকে ৭০-৮০ ফুট নিচে নেমে টয়লেট ও গোসলের কাজ সারতে হচ্ছে। দিনের বেলায় যেমন তেমন, রাতের বেলায় নারীদের অনেক দূরে গিয়ে টয়লেট ও গোসল করতে ঝামেলা হয়।
এই পাহাড়চূড়ায় দাঁড়ালে ধ্বংসযজ্ঞের পুরোটা চোখে পড়ে। পাঁচ বর্গকিলোমিটার এলাকার ধ্বংসস্তূপের ওপর সম্প্রতি সাদা, কমলা ও সবুজ ত্রিপলের ছাউনিযুক্ত হাজারো ঝুপড়িঘর দাঁড়িয়ে আছে। এখানে ঠাঁই হয়েছে অন্তত ৫০ হাজার রোহিঙ্গার। রান্নাবান্না ও ঘুমানো—দুটোই হচ্ছে ত্রিপলের নিচে।
বালুখালী ক্যাম্পের বলিবাজার এলাকার রোহিঙ্গা নজির আহমদ (৫২) বলেন, অগ্নিকাণ্ডের সময় পরনের কাপড় ছাড়া কিছুই রক্ষা করা যায়নি। এখন বাঁশ ও ত্রিপল টাঙিয়ে কোনো রকমে মাথা গোঁজার ঠাঁই হলেও নানা ধরনের ভোগান্তির শিকার হতে হচ্ছে। ঘরে কিশোরী-তরুণী মেয়েদের নিয়ে ত্রিপলের ছাউনিতে থাকা কষ্টকর।
বলিবাজার পাহাড়ের ঢালুতে বাঁশ দিয়ে একটি নতুন ঘর তৈরি করছেন রোহিঙ্গা খায়রুল আমিন। তাঁর আশপাশে তৈরি হয়েছে আরও ১০ থেকে ১২টি ঘর। অপরিকল্পিতভাবে ঘর তৈরির বিষয়ে তিনি বলেন, প্রচণ্ড গরমে ত্রিপলের ছাউনিতে থাকা মুশকিল। তাই নিজের টাকায় ঘর তৈরির চেষ্টা করছেন। ঘর তৈরিতে এ পর্যন্ত ২৩ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। এর মধ্যে ১৩ হাজার টাকা পেয়েছেন স্ত্রীর সোনার গয়না বিক্রি করে। স্ত্রী, চার ছেলে, দুই মেয়েসহ আটজনের সংসার খায়রুলের।
বালুখালী-৯ ক্যাম্পের সি-ব্লকের রোহিঙ্গা দলনেতা মোহাম্মদ হাসান বলেন, ত্রিপলের নিচে অমানবিক জীবন শুরু করলেও রোহিঙ্গারা আসন্ন বর্ষা নিয়ে চরম আতঙ্কে।
কারণ বর্ষায় পাহাড় থেকে নেমে আসা ঢলের পানিতে মুহূর্তে ত্রিপলের ছাউনির ঘর তলিয়ে যেতে পারে। আর ঝড়-তুফান হলে ত্রিপলের নিশানাও খুঁজে পাওয়া যাবে না।
পুড়ে গেছে ত্রাণ কার্ড, কার্ড চান দ্রুত
বালুখালী ক্যাম্প-৮-এর বাসিন্দা খতিজা বেগম (৩২) বলেন, ২২ মার্চের আগুনে তাঁর নগদ টাকা, স্বর্ণালংকার, কাপড়চোপড়ের সঙ্গে বিশ্ব খাদ্য সংস্থা (ডব্লিউএফপি) থেকে সরবরাহকৃত রেশন কার্ডটি আগুনে পুড়ে গেছে। নতুন কার্ডও পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে রোজার মাসে খাবার নিয়ে সংকটে ছিলেন তিনি। বিধবা এই নারী তিন সন্তান নিয়ে থাকছেন ত্রিপলের ছাউনিতে। দোকান থেকে চাল, তেল, তরকারি কেনার মতো সহায়-সম্বল কিছুই নেই তাঁর। তিনি বলেন, শুরুতে কিছুদিন দুই বেলা রান্না করা খাবার দেওয়া হয়েছিল। তারপর সবকিছু বন্ধ। সম্প্রতি সেনাবাহিনীর সদস্যরা চাল-তেলসহ প্রয়োজনীয় ত্রাণ সহায়তা দিয়েছেন, তা দিয়ে কোনোমতে চলছেন।
আগুনে পুড়ে যাওয়া কার্ড নতুন করে তৈরির কাজ তত্ত্বাবধান করছে আইওএম। আইওএমের ন্যাশনাল কমিউনিকেশন অফিসার তারেক মাহমুদ বলেন, যাঁদের রেশন কার্ড পুড়ে গেছে, যাচাই-বাছাই করে তাঁদের নতুন কার্ড সরবরাহ করা হচ্ছে। মে মাসের মধ্যে কার্ড সমস্যার সমাধান হবে বলে তিনি আশাবাদী।