ধান বাঁচানোর পানি না পেয়ে কৃষকের বিষপান
রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার দুই কৃষক বিষপান করেছেন। এর মধ্যে এক কৃষকের মৃত্যু হয়েছে। অপরজনের অবস্থা সংকটাপন্ন। কৃষক দুজন সম্পর্কে চাচাতো ভাই। তাঁদের পরিবারের দাবি, ১০–১২ দিন অপেক্ষার পরও ধানের জমিতে পানি নিতে না পারার ক্ষোভ থেকে তাঁরা আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন।
তবে জমিতে পানি না পেয়ে তাঁদের বিষপানের ঘটনা নিয়ে প্রশ্ন তুলছে বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিএমডিএ) ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। বিএমডিএর অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী আবদুর রশিদের ভাষ্য, তাঁরা দুই কৃষকের বিষপানের কথা শুনেছেন। পানির অভাবে তাঁদের জমির ধান মারা যায়নি। সেই শোকে তাঁরা বিষপান করেছেন—এটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। এখন পানি দেওয়ার ক্ষেত্রে অপারেটরের কোনো অনিয়ম থাকলে তাঁর বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বিষপান করা দুজন উপজেলার দেওপাড়া ইউনিয়নের নিমঘটু গ্রামের অভিনাথ মারান্ডি (৩৬) ও রাবি মারান্ডি (২৭)। এর মধ্যে গত বুধবার রাতেই মারা গেছেন অভিনাথ। রাবি রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বরেন্দ্র অঞ্চলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে গেছে। আগের মতো পানি ওঠে না। গভীর নলকূপ থেকে কৃষকদের পানি কিনে নিতে হয়। পালাক্রমে পানির জন্য অপেক্ষা করতে হয়। একজন অপারেটর পালাক্রমে কৃষকের জমিতে পানি দিয়ে থাকেন। গোদাগাড়ীর দেওপাড়া ইউনিয়নের ঈশ্বরীপুর গ্রামের একটি গভীর নলকূপের অধীনে ২৬০ বিঘা জমিতে এবার বোরো ধান চাষ করা হয়েছে। এই নলকূপের অধীনেই বোরো চাষ করেছিলেন পাশের নিমঘটু গ্রামের অভিনাথ ও রাবি।
অভিনাথের স্ত্রী রোজিনা হেমরম বলেন, বিএমডিএর ঈশ্বরীপুর গভীর নলকূপের আওতায় তাঁদের দেড় বিঘা বর্গা জমিতে ধান আছে। সেই ধানের জমিতে ঠিকমতো পানি পাওয়া যায় না। এই দুঃখে গভীর নলকূপের কাছে গিয়েই তাঁর স্বামী বিষ খেয়েছেন। তাঁদের দুই ছেলে হৃদয় মার্ডির বয়স ১০ বছর, আর রাজকুমার মার্ডির বয়স ৬। গত বছর সরকারিভাবে টিনের বেড়ার একটি ঘর করে দেওয়া হয়েছে। সেই ঘরে চার সদস্যের পরিবার নিয়ে থাকেন। ঘরে একমুঠো চাল ছাড়া আর কিছু নেই।
বৃহস্পতিবার দুপুরে গিয়ে দেখা যায়, নিমঘটু গ্রামে গোদাগাড়ী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) জানে আলম, গোদাগাড়ী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কামরুল হাসান ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা বসে আছেন। ইউএনও বলেন, ঘটনা শোনার পরেই তিনি এখানে এসেছেন। কীভাবে ঘটনাটি ঘটল, তাঁরা খতিয়ে দেখছেন। অভিযোগ সত্য হলে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
ওসি বলেন, চৈত্র মাস। আট-দশ দিন জমিতে পানি পায় না। এ জন্যই কি একজন মানুষ বিষ খেয়ে মারা যেতে পারেন? বিষয়টি তদন্ত করে দেখা হবে। ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পরে ঘটনার কারণ জানা যাবে। দুপুরে অভিনাথের লাশ ময়নাতদন্তের জন্য রাজশাহী মেডিকেল কলেজের মর্গে পাঠানো হয়েছে।
গ্রামের ভ্যানচালক বাপ্পি মারান্ডি গত বুধবার বিকেল পাঁচটার দিকে ওই গভীর নলকূপের কাছ দিয়ে ভ্যান নিয়ে আসছিলেন। তখন নলকূপের অপারেটর সাখাওয়াত হোসেন ওই ভ্যানে অভিনাথকে তুলে দেন। বাপ্পি জানান, তখনো অভিনাথ কথা বলছিল। সাখাওয়াতকে বলছিল, ‘আমি বিষ খেয়ে নিয়েছি। আমি মরে যাব।’ বাপ্পি বলেন, তখন অভিনাথের মুখ দিয়ে লালা ঝরছিল, আর কাশছিলেন। বাড়িতে নিয়ে এলে সন্ধ্যার পরে অভিনাথ মারা যান।
অভিনাথকে বাড়িতে আনার পর নলকূপের কাছ থেকে ধরাধরি করে রাবি মারান্ডিকে বাড়িতে নিয়ে আসে লোকজন। রাতেই তাঁকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। হাসপাতালের ১৬ নম্বর ওয়ার্ডে গিয়ে দেখা যায়, রাবির কাছে তাঁর মা দলিনা মুর্মু আর ভগ্নিপতি সুনীল মুর্মু বসে আছেন। তাঁরা কিছুই বলতে পারেননি। বিষক্রিয়ার কারণে রাবিও ঠিকঠাক কথা বলতে পারছেন না। কেন বিষ পান করেছেন, অনেকবার জিজ্ঞাসা করার পর একবার শুধু বললেন, ‘দুঃখ লেগেছিল।’ এরপরই আবার বিকারগ্রস্ত হয়ে পড়েন।
বৃহস্পতিবার দুপুরে গিয়ে দেখা যায়, অভিনাথের লাশ তাঁর বাবার বাড়ির বারান্দায় ঢেকে রাখা ছিল। লাশ ঘিরে তাঁর মা সোহাগী সরেন ও বোন রুপিনা মার্ডিসহ একদল নারী ও শিশুর কান্নার রোল শোনা যাচ্ছিল। সাঁওতালী ভাষায় বিলাপ করে তারা কাঁদছিলেন। মায়ের নাম জানতে চাইলে হঠাৎ কান্না ভুলে কঠিন গলায় মা সোহাগী বলে উঠলেন, ‘নাম দিয়ে কী হবে? আমাদের ওপরে এই অন্যায়ের বিচার করবে কে?’
প্রশাসনের লোকজনের কাছে চিৎকার করে উন্নয়নকর্মী ক্যাথেরিন হাঁসদা বলছেন, ‘ধানখেতে ১০-১২ দিন ধরে পানি পড়েনি। পানির জন্য গেলে তাঁদের শুধু ঘোরানো হয়। সহ্য করতে না পেরে একজন কৃষক বিষ খেয়ে মারা গেছেন। আরেকজন হাসপাতালে পড়ে আছেন। আমরা এর বিচার চাই। যাতে ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা আর না ঘটে।’
পানি বণ্টনে অনিয়মের কথা বলতে গিয়ে নিমঘটু গ্রামের কৃষক হাবিল মুর্মু বলেন, তাঁর ধানের চারা লাগানো ৫০ দিন হয়ে গেছে। লাগানোর পর আর এক দিনও নলকূপের অপারেটর সাখাওয়াত পানি দেননি। ধান বাঁচাতে তিনি পাশের নলকূপ থেকে ১২ ঘণ্টা পানি কিনে নিয়েছেন। সাখাওয়াতের নলকূপের পানির সিরিয়ালের ঠিক নেই।
নলকূপের অপারেটর সাখাওয়াতের বিরুদ্ধে একই অভিযোগ কৃষক সাগর মার্ডির। তিনি বলেন, আজ, কাল, পরশু করে অপারেটর সাখাওয়াত তাঁদের শুধু ঘোরান।
সাখাওয়াত হোসেন তাঁর সামনে অভিনাথ মারান্ডির বিষপানের কথা অস্বীকার করে বলেন, তিনি জানতেন না যে অভিনাথ বিষ পান করেছিলেন। অভিনাথ মারা যাওয়ার খবর শুনে তাঁর জমিতে তড়িঘড়ি করে নলকূপ অপারেটর পানি দিয়েছেন।
অবশ্য বিষয়টি অস্বীকার করেছেন সাখাওয়াত। তাঁর দাবি, গত ২২ মার্চ অভিনাথের জমিতে তিনি পানি দিয়েছেন। কিন্তু খাতায় এর কোনো রেকর্ড দেখাতে পারেননি। জমিতে গিয়েও দেখা যায় সদ্য দেওয়া পানি। লোকজন বলছেন, অভিনাথের মারা যাওয়ার খবর পাওয়ার পর এই পানি দেওয়া হয়েছে।