ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড করার দাবিতে নানা স্থানে সমাবেশ ও মানববন্ধন
সিলেট, হবিগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে একের পর এক ধর্ষণের ঘটনার প্রতিবাদ এবং এসব ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের দাবি জানিয়েছে নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন। মঙ্গলবার বরিশাল, সুনামগঞ্জ, রাজশাহী, রংপুর, নোয়াখালীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে মানববন্ধন ও সমাবেশ করে এই দাবি জানানো হয়।
নোয়াখালীতে গৃহবধূকে বিবস্ত্র করে নির্যাতন ও ধর্ষণের চেষ্টা, দেশের বিভিন্ন স্থানে ধর্ষণ ও নারীর প্রতি সহিংসতাসহ সব ধরনের সামাজিক অনাচারের প্রতিবাদে বরিশালে গণ-অবস্থান ও মানববন্ধন হয়েছে। মঙ্গলবার বেলা ১১টায় নগরের অশ্বিনীকুমার টাউন হলের সামনে সাধারণ শিক্ষার্থীরা এই কর্মসূচির আয়োজন করেন। একই সময়ে বরিশাল প্রেসক্লাবের সামনে পৃথক মানববন্ধন ও সমাবেশের আয়োজন করে বাংলাদেশ ছাত্র ও যুব অধিকার পরিষদ বরিশাল শাখা। এতে একাত্মতা প্রকাশ করে অংশগ্রহণ করে সামাজিক প্রতিরোধ কমিটি, নারী নির্যাতন প্রতিরোধ জোট, ব্লাস্ট বরিশাল ইউনিট ছাড়াও বিভিন্ন সংগঠন।
বরিশাল শহরের অশ্বিনীকুমার হলের সামনে মানববন্ধন ও গণ-অবস্থান চলাকালে সমাবেশে বক্তারা বলেন, ধর্ষণ করে পার পেয়ে যাওয়া আর বিচারহীনতার যে সংস্কৃতি গড়ে উঠছে, তাতে এই অনাচার মহামারিতে রূপ নিচ্ছে। এ জন্য আজ দেশের মানুষকে ধর্ষকদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। সরকারকে ধর্ষণের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে।
সমাবেশে বক্তারা আরও বলেন, নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে বিবস্ত্র করে বর্বরোচিত নারী নির্যাতনের ঘটনায় গোটা দেশ স্তব্ধ। নারী নির্যাতনের ঘটনা যে কতটা ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে তা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে এই জঘন্য ঘটনা। এই ঘটনা একাত্তরের বর্বরতাকে হার মানিয়েছে। বক্তারা অবিলম্বে এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত ঘৃণ্য অপরাধীদের গ্রেপ্তার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান। একই সঙ্গে দেশে অব্যাহত ধর্ষণ, গণধর্ষণ ও নারী নির্যাতনের ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি করেন। সমাবেশে বক্তব্য দেন নারী নেত্রী শাহ সাজেদা, পুষ্প চক্রবর্তী, আইনজীবী শাহিদা তালুকদার, টুনু রানী, মানবাধিকার কর্মী রফিকুল আলম, শুভঙ্কর চক্রবর্তী, রণজিৎ দত্ত প্রমুখ। প্রেসক্লাবের সামনে বাংলাদেশ ছাত্র ও যুব অধিকার পরিষদ বরিশাল শাখা আয়োজিত সমাবেশে বক্তৃতা করেন রনি খন্দকার, আতাউল্লাহ, আরিফুল ইসলাম, শহিদুল সাঈদ প্রমুখ।
মঙ্গলবার সকালে সুনামগঞ্জ পৌর শহরের আলফাত স্কয়ার এলাকায় মানববন্ধন করা হয়। এতে বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার মানুষ অংশ নেন। মানববন্ধনে বক্তারা বলেন, দেশে নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে। নারী-শিশুরা ঘরে-বাইরে কোথাও এখন নিরাপদ নয়। এ জন্য সমাজের সর্বত্র এখন একটা ভীতিকর অবস্থা বিরাজ করছে। রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন, আইনের যথাযথ প্রয়োগের অভাব, সরকারের উদাসীনতা এ জন্য দায়ী। যুব ও তরুণ সমাজের একটি অংশ রাজনৈতিক প্রশ্রয়ে এসব করছে। তাই প্রতিটি ঘটনার সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের মদদদাতাদেরও আইনের আওতায় আনতে হবে। অন্যথায় এসব অপকর্ম বন্ধ হবে না। ধর্ষকদের সর্বোচ্চ শাস্তি দিতে হবে। পাশাপাশি এসব জঘন্য কর্মকাণ্ড রুখতে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। রাষ্ট্রকে নারী ও শিশুদের নিরাপত্তায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।
মানববন্ধন চলাকালে বক্তব্য দেন জেলা মহিলা পরিষদের সহসভাপতি সঞ্চিতা চৌধুরী, জেলা উদীচী শিল্পী গোষ্ঠীর সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম, জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক মিন্টু চৌধুরী, জেলা ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি দুর্জয় দাস, সাধারণ সম্পাদক আসাদ মনি, ছাত্রনেতা মনির হোসেন প্রমুখ।
ধর্ষকের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড করার দাবিতে মঙ্গলবার বেলা ১১টার দিকে রাজশাহী নগরের সাহেববাজার জিরোপয়েন্টে অবস্থান কর্মসূচির আয়োজন করা হয়। এতে শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন পেশার মানুষ অংশ নেন। কর্মসূচিতে বক্তারা বলেন, নোয়াখালীতে গৃহবধূকে বিবস্ত্র করে যে ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটেছে, তা সারা দেশের মানুষকে নাড়া দিয়েছে। গত আট মাসে ১ হাজার ৯৩টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। এটা শুধু নথিভুক্ত ধর্ষণের ঘটনা। ধর্ষণ এখন মহামারি আকার ধারণ করেছে। বিচারহীনতার জন্যই এ ঘটনা ঘটছে। সরকারকে তাই এ ক্ষেত্রে কঠোর পদক্ষেপ নিয়ে দ্রুত বিচার আইনে ধর্ষকের সর্বোচ্চ শাস্তি দিতে হবে। সেই সঙ্গে ধর্ষণের মামলা জামিনের অযোগ্য করতে হবে।
কর্মসূচিতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফোকলোর বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আমিরুল ইসলাম সংহতি জানিয়ে বলেন, ‘বিচারহীনতার কারণে ধর্ষণ আজ দেশব্যাপী মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়েছে। নারীকে মানুষ হিসেবে ভাবতে শিখতে হবে। একই সঙ্গে আমাদের মস্তিষ্কের ভেতর থেকে নারী সম্পর্কে নেতিবাচক চিন্তা দূর করতে হবে। এর পাশাপাশি রাষ্ট্র ব্যবস্থাপনায় অসংগতি, অবিচার দূর করতে হবে। বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। এ জন্য একটি গণ-আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।’
কর্মসূচিতে আইনজীবী লিসা আনজুমান্দ বলেন, ‘বাংলাদেশে প্রতিদিনই ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে। এই ধর্ষণের বিচার চাইতে আমরা বারবার রাস্তায় নেমে আসছি। কিন্তু আর কত? আমরা ধর্ষণের বিচার সর্বোচ্চ শাস্তি ফাঁসি চাই। যখনই কোনো ধর্ষণের ঘটনা ঘটে, তখন নারীদের ঘরে থাকতে বলা হয়। কিন্তু সেই ঘরও আজ নিরাপদ নয়। সেখানেও নারী ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। তাহলে নারীরা যাবে কোথায়। বিচারহীনতার কারণে এই ঘটনা বারবার ঘটছে। আমাদের বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে বের হতে হবে।’
কর্মসূচি থেকে শিক্ষার্থীরা ঘোষণা দেন, বুধবার বেলা সাড়ে ১১টায় রাজশাহী নগরের সাহেববাজার জিরোপয়েন্টে গণস্বাক্ষর কর্মসূচি পালন করা হবে। এই কর্মসূচি পালন শেষে রাজশাহী জেলা প্রশাসকের কাছে স্মারকলিপি পেশ করা হবে।
মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ১০টায় রংপুর প্রেসক্লাবের সামনে ‘ধর্ষণ ও নিপীড়নবিরোধী ছাত্রজনতা’ ব্যানারে মানববন্ধন হয়েছে। ঘণ্টাব্যাপী এ কর্মসূচি চলাকালে বক্তব্য দেন ছাত্র অধিকার পরিষদ রংপুর জেলা শাখার আহ্বায়ক হানিফ খান, যুগ্ম আহ্বায়ক ইমরান আহমেদ, সদস্য শাহ আলম, ইয়াসির আরাফাত, নিপু আক্তার, চিনু কবীর, আশিকুর রহমান প্রমুখ। বেলা সাড়ে ১১টা থেকে দুপুর সাড়ে ১২টা পর্যন্ত ঘণ্টাব্যাপী একই স্থানে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ব্যানারে পৃথক মানববন্ধন হয়।
এ সময় এক সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন কমিউনিটি মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থী সৈয়দ অর্পণ রহমান। এতে সংহতি জানিয়ে বক্তব্য দেন মহিলা পরিষদের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক হাসনা চৌধুরী ও রুম্মানা জামান, নারী মুক্তি আন্দোলনের কামরুন্নাহার শিখা, জনতার রংপুর সংগঠনের আহ্বায়ক সৈয়দ মামুনুর রহমান, সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের সভাপতি যুগেশ ত্রিপুরা, জাসদের সভাপতি গৌতম কুমার রায়, ওয়ার্কার্স পার্টির মাজেরুল ইসলাম প্রমুখ।
বক্তারা বলেন, দেশে একের পর এক ধর্ষণ ও নারীর প্রতি নিপীড়ন-নির্যাতন বেড়েই চলেছে। ধর্ষণের ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের অধিকাংশই ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মী। তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিয়ে এসব ন্যক্কারজনক কর্মকাণ্ড বন্ধ করতে হবে।
এসব কর্মসূচিতে নগরের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা ছাড়াও ২৫টির অধিক সংগঠন অংশ নেয়।
নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ উপজেলায় এক নারীকে (৩৭) বিবস্ত্র করে নির্যাতন ও তাঁকে ধর্ষণের চেষ্টার প্রতিবাদে দ্বিতীয় দিনের মতো মানববন্ধন-সমাবেশ অব্যাহত রয়েছে। মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে বৃষ্টি উপেক্ষা করে বিভিন্ন সংগঠন নোয়াখালী প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধন ও সমাবেশ করে। বেলা সাড়ে ১১টার দিকে একই স্থানে জেলা বিএনপির উদ্যোগেও মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশ করা হয়। বিএনপির এই কর্মসূচিতে জেলা বিএনপি, যুবদল ও ছাত্রদলের নেতারা বক্তব্য দেন।
এ ছাড়া দুপুর ১২টার দিকে শহরের টাউন হল মোড়ে জেলা বাম জোটের উদ্যোগে মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশ হয়েছে। সমাবেশে বক্তারা অবিলম্বে নারী নির্যাতনের ঘটনার নেপথ্যে থাকা দেলোয়ার বাহিনীর প্রধান দেলোয়ারকে এই মামলায় গ্রেপ্তার দেখানোর দাবি জানান এবং ঘটনার সঙ্গে জড়িত সবার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি করেন।
প্রেসক্লাবের সামনে সকালে নোয়াখালী মানবিক ব্ল্যাড ফাউন্ডেশন, আমাদের নোয়াখালী, এসএসসি (১৯৭২-২০২০) ব্যাচের শিক্ষার্থীদের উদ্যোগে আয়োজিত মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশে আয়োজক সংগঠনের সদস্য ছাড়াও বিভিন্ন স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা অংশগ্রহণ করে।
(প্রতিবেদন তৈরিতে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন নিজস্ব প্রতিবেদক, বরিশাল, সুনামগঞ্জ, রংপুর, নোয়াখালী ও প্রতিনিধি, রাজশাহী)