দেশে ফিরে ভয়ংকর অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিলেন বেঁচে যাওয়া দুজন

বেঁচে ফেরা ইউসুফ মৃধা
ছবি: সংগৃহীত

‘আমি একাই একজনের শার্টের কলার, আরেকজনের মাফলার ধরে দুই হাতে আরও দুজনসহ মোট চারজনকে ভাসিয়ে রেখেছিলাম। তীব্র ঠান্ডায় তাঁদের মধ্যে একজনের মৃত্যু হলে আমি হাত ছেড়ে দিতে বাধ্য হই। এভাবে একেক করে কেউ ডুবে যাচ্ছিলেন, কেউ ভেসে যাচ্ছিলেন। নিজেরা বাঁচব, নাকি অন্যদের বাঁচাব—এ ভেবেই সময়গুলো একটা ঘোরের মধ্যে কাটছিল।’

কথাগুলো বলছিলেন নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলার মো. খোরশেদ মৃধার ছেলে ইউসুফ মৃধা (২৯)। গত ২৭ জানুয়ারি ভূমধ্যসাগরে স্পিডবোটডুবির ঘটনায় বেঁচে যাওয়া ব্যক্তিদের একজন তিনি। লিবিয়া থেকে স্পিডবোটে করে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালি যাওয়ার পথে ২৭ জানুয়ারি ওই দুর্ঘটনা ঘটে।

তীব্র ঠান্ডায় ভেসে থাকার ১১ ঘণ্টা পর কোস্টগার্ডের সদস্যরা উল্টে যাওয়া স্পিডবোটের ওপরে অবস্থান করা জীবিত সাতজনকে উদ্ধার করেন। তবে তীরে পৌঁছার আগেই ঠান্ডায় জমে একজনের মৃত্যু হয়। ঘটনার ৩৫ দিন পেরিয়ে গেলেও ভূমধ্যসাগরে এখনো নিখোঁজ ২৮ জন, তাঁদের মধ্যে ১৫ জনই নরসিংদীর।

এত দিনেও নিখোঁজ ২৮ বাংলাদেশির কোনো সন্ধান না পাওয়ায় ধারণা করা হচ্ছে, তাঁদের সবারই সলিলসমাধি হয়েছে।

বেঁচে যাওয়া ছয়জনের মধ্যে দুজন গত বৃহস্পতিবার দেশে ফিরেছেন। ইউসুফের সঙ্গে ফেরা অন্যজন হলেন ফরিদপুরের নগরকান্দার মো. ইউনুস শেখের ছেলে শেখ সামিউল (১৮)। বর্তমানে এই দুজন রাজধানীর হজ ক্যাম্পে হোম কোয়ারেন্টিনে আছেন। তাঁদের দুজনের পাশাপাশি স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে কীভাবে এই মর্মান্তিক ঘটনা ঘটেছিল, তা জানা গেছে।

গতকাল শুক্রবার বিকেলে মুঠোফোনে ইউসুফ মৃধা ও শেখ সামিউল বলেন, ২৭ জানুয়ারি লিবিয়ার স্থানীয় সময় রাত ৮টার দিকে দুই মিসরীয় চালক তাঁদের ৩৫ জনকে নিয়ে ইতালির উদ্দেশে রওনা হন। ভূমধ্যসাগর পাড়ি দেওয়ার সময় পড়ে যাওয়া একজনকে তুলতে গিয়ে স্পিডবোটটি উল্টে যায়। এরপর ওই তীব্র ঠান্ডা পানিতে প্রায় ১১ ঘণ্টা ভেসে ছিলেন তাঁরা। চোখের সামনে ১০-১২ জনকে মারা যেতে দেখেছেন। কূলকিনারাহীন সাগরে ঢেউয়ের ধাক্কায় একেক করে ভেসে গেছেন তাঁরা। তবে তাঁরা ছয়জন উল্টে যাওয়া স্পিডবোটের ওপরে অবস্থান করায় বেঁচে গেছেন। এত দিনেও নিখোঁজ ২৮ বাংলাদেশির কোনো সন্ধান না পাওয়ায় ধারণা করা হচ্ছে, তাঁদের সবারই সলিলসমাধি হয়েছে।

স্পিডবোটডুবির ঘটনায় নিখোঁজ (ওপরে, বা থেকে) সালাউদ্দিন, নাদিম সরকার, (নিচে) শরীফুল ইসলাম ও শাওন মিয়া
ছবি: সংগৃহীত

নিখোঁজ ব্যক্তিদের মধ্যে নরসিংদীর ১৫ জনের নাম-পরিচয় জানা গেছে। তাঁরা হলেন রায়পুরার ডৌকারচরের নাদিম সরকার (২২), আলমগীর সরকার (৩৫), আল-আমিন ফরাজী (৩৩); দক্ষিণ মির্জানগরের এস এম নাহিদ (২৫); আমিরগঞ্জের ইমরান মিয়া (২১), আশিস সূত্রধর (২১), সবুজ মিয়া (২৫), হাইরমারার শাওন মিয়া (২২), সেলিম মিয়া (২৪); বেলাব উপজেলার আল আমিন (২৮); নারায়ণপুরের মতিউর রহমান (৩৭); সল্লাবাদের শরীফুল ইসলাম (২৪), সালাউদ্দিন (৩২), মো. হালিম (২৬), বিপ্লব মিয়া (২৪)। বাকি ১৩ জন ফরিদপুর, কিশোরগঞ্জ, বরিশাল, মাদারীপুর, গোপালগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, গাজীপুর ও সিলেট জেলার বাসিন্দা।

স্পিডবোটডুবির ঘটনায় নিখোঁজ (ওপরে, বা থেকে) মতিউর রহমান, আশিস সূত্রধর, (নিচে) ইমরান মিয়া ও আলম ফরাজী
ছবি: সংগৃহীত

রায়পুরার ডৌকারচরের নিখোঁজ তিনজনের পরিবারের সদস্যরা বলেন, রায়পুরার আমিরগঞ্জের হাসনাবাদের তারেক মোল্লা নামের এক দালালের সঙ্গে ইতালি পর্যন্ত যাওয়ার জন্য সাড়ে আট লাখ টাকায় চুক্তি করেন তাঁরা। সাড়ে ছয় লাখ টাকা করে তাঁর হাতে দেওয়ার পর গত ২৭ ডিসেম্বর তাঁরা ইতালির উদ্দেশে রওনা হন। প্রথমে তাঁদের দুবাই নিয়ে এক সপ্তাহ রাখা হয়। পরে মিসর হয়ে তাঁদের পাঠানো হয় লিবিয়ার বেনগাজী শহরে। সেখানে খাদ্যসংকটে আরও প্রায় ১০ দিন থাকার পর ব্যক্তিগত গাড়ির ডেকের ভেতরে ভরে দুই দিনের যাত্রা শেষে তাঁদের নেওয়া হয় ত্রিপোলি শহরে। সেখানে তাঁরা দেখা পান এই চক্রের মূল দালাল মনির চন্দ্র শীল নামের এক ব্যক্তির, যাঁর বাড়ি নরসিংদীর রায়পুরার আমিরগঞ্জের হাসনাবাদে।

আরও পড়ুন

বেঁচে ফেরা দুজন বলছেন, ২০-২৫ জনকে প্রায় এক সপ্তাহ মনির চন্দ্রের বাড়িতে রাখা হয়। সেখানেই তাঁরা জানতে পারেন, বৈধভাবে ইতালিতে নেওয়ার কথা বলে আনা হলেও তাঁদের পাঠানো হবে অবৈধভাবে। পরে তাঁদের জানানো হয়, ৩০০ সিসির দুই ইঞ্জিনের একটি স্পিডবোটে করে তাঁদের নেওয়া হবে, যার ধারণক্ষমতা অন্তত ৫০ জন। মোট ৪২ জনকে নিয়ে জোয়ারা ঘাটে গেলে দেখা যায়, ওই স্পিডবোটটিতে ১৬০ সিসির একটি ইঞ্জিন রয়েছে, যার ধারণক্ষমতা সর্বোচ্চ ২৫ জন। ২৫ জনের জায়গায় ৪২ জনকে ওঠানো হলে চালক ৫ জনকে নামিয়ে দেন। ২৭ জানুয়ারি স্থানীয় সময় রাত ৮টার দিকে মিসরীয় দুই চালক স্পিডবোটটিতে ৩৫ জন বাংলাদেশিকে নিয়ে ইতালির উদ্দেশে রওনা হন। এভাবে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দেওয়াকে বলা হয় গেম বা গেমিং।

শেখ সামিউল (১৮)
ছবি: সংগৃহীত

শেখ সামিউল বলেন, ‘২৫ জনের ধারণক্ষমতার স্পিডবোটে আমরা ছিলাম ৩৫ জন। লাইফ জ্যাকেট বা কোনো ধরনের সেফটি ইকুইপমেন্ট আমাদের কাউকে দেওয়া হয়নি। তিউনিশিয়া পার হয়ে মাল্টা জলসীমা অতিক্রম করার সময় আমাদের একজন চলন্ত স্পিডবোট থেকে সাগরে পড়ে যান। স্পিডবোট ঘুরিয়ে তাঁকে টেনে তোলার সময় এটি একদিকে কাত হয়ে যায়। এ সময় ঢেউয়ের ধাক্কায় স্পিডবোটটি উল্টে গেলে সব যাত্রী সাগরে ডুবে যান। সাতজন কোনোরকমে উল্টে যাওয়া স্পিডবোটের ওপরে উঠতে পেরেছিলাম। এ সময় স্পিডবোট ধরে ভেসে ছিলেন অন্তত ১৫ জন। ভেসে থাকতে থাকতে বেশ কয়েকজনকে মারা যেতে দেখেছি। আবার অনেকে ঢেউয়ের তোড়ে ভেসে গেছেন অনেক দূরে। ইতালি পৌঁছার আর মাত্র এক ঘণ্টার মতো দূরত্ব বাকি ছিল।’

বেঁচে ফেরা ইউসুফ মৃধা বলেন, ‘একটা সময় বহুদূরে কোস্টগার্ডের একটি জাহাজ ভেসে যেতে দেখি। আমাদের মধ্যে একজনের লাল জামা পরা ছিল, তাঁর জামা খুলে উড়াতে থাকি আমরা। পরে তারা এসে আমাদের সাতজনকে উদ্ধার করে নিয়ে যায়। উদ্ধার করে তীরে নেওয়ার পথেই রাশেদুলের মৃত্যু হয়। আমাদের ছয়জনকে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়ার পর প্রায় এক মাস জেলে রেখে স্থানীয় দূতাবাসের সহযোগিতায় দেশে ফেরার ব্যবস্থা করা হয়। বৃহস্পতিবার সকালে আমরা দুজন দেশে ফিরেছি, অন্য চারজনও দ্রুতই দেশে ফিরবেন।’

লিবিয়া হয়ে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে ঢুকতে গিয়ে এক দশকে কমপক্ষে ৬৫ হাজার বাংলাদেশি শুধু আটকই হয়েছেন। প্রাণ হারিয়েছেন পাঁচ শতাধিক মানুষ।
শরিফুল হাসান, ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচির প্রধান

নিখোঁজ নাদিম সরকারের বাবা সোবহান সরকার বলেন, দালাল তারেক মোল্লার মাধ্যমেই রায়পুরার ১২ জনসহ বিভিন্ন জেলার ২০-২৫ জন লোক ইতালির উদ্দেশে রওনা হয়েছিলেন। তাঁর ও মনির চন্দ্র শীলের মতো দালালদের প্রলোভনের ফাঁদে পড়েই আজ ৩০টি পরিবারে কান্নার রোল উঠেছে। তাঁদের কঠোর শাস্তি হলে এই ২৮ জনের আত্মা শান্তি পাবে।

জানুয়ারিতে ভূমধ্যসাগরের তাপমাত্রা থাকে হিমাঙ্কের নিচে
ফাইল ছবি: রয়টার্স

বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচির প্রধান শরিফুল হাসান বলেন, লিবিয়া হয়ে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে ঢুকতে গিয়ে এক দশকে কমপক্ষে ৬৫ হাজার বাংলাদেশি শুধু আটকই হয়েছেন। প্রাণ হারিয়েছেন পাঁচ শতাধিক মানুষ। যে পরিমাণ টাকা দিয়ে তাঁরা এমন ঝুঁকি নেন, এ দিয়ে কিন্তু তাঁরা নিজেদের এলাকাতেই কিছু করতে পারেন। স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক দালালদের চিহ্নিত করে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা না নিলে এই প্রবণতা কমবে না।

আরও পড়ুন

নরসিংদীর জেলা প্রশাসক আবু নইম মোহাম্মদ মারুফ খান বলেন, বিষয়টি এইমাত্র শুনলেন তিনি। নিখোঁজ ব্যক্তিদের পরিবারের কোনো সদস্যও এ বিষয়ে কিছু জানাননি। এ বিষয়ে কতটুকু কী করা সম্ভব, তা খোঁজ নিয়ে দেখা হবে। স্থানীয় দালালদের বিরুদ্ধেও আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

জেলা প্রশাসক আরও বলেন, ‘অভিবাসনপ্রত্যাশী ব্যক্তিদের কাছে প্রকৃত চিত্র তুলে ধরার জন্য জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে প্রবাসীকল্যাণ ডেস্ক রয়েছে। আমার অনুরোধ থাকবে, স্থানীয় দালালদের মাধ্যমে ঝুঁকি নিয়ে বিদেশ যাওয়ার চেষ্টা না করে, ভালো করে খোঁজখবর নিয়ে যেন সবাই বিদেশগামী হন। তাহলে আর কোনো মায়ের বুক এভাবে খালি হবে না।’