দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী অছিমের কণ্ঠে সুরের জাদু
‘দোতারার চিকন তারে যদি সুর তুলতে পারিস, তাহলে কোনো দিন তোর ভাতের অভাব হবে না।’ ঠিক এ কথাটাই দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী বয়াতি অছিম উদ্দীন মণ্ডলকে বলেছিলেন তাঁর ওস্তাদ বাউল আবদুল হান্নান। সে কথা ফলেছে অনেক আগেই।
সারাটা জীবন কেটেছে অভাব-অনটনে। কিন্তু বাউল হান্নানের (বর্তমানে প্রয়াত) শিষ্যত্ব গ্রহণের পর সবকিছু পাল্টে গেছে অছিমের। প্রায় তিন দশক ধরেদেশের এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্তে দোতারা বাজিয়ে গান গেয়ে জীবিকা নির্বাহ করে চলেছেন। শুধু তাই নয়, গ্রামীণ জনপদে ‘অন্ধ বয়াতি অছিম’ নামে তিনি অনেক জনপ্রিয়। নিজের ভিজিটিং কার্ড বানিয়েছেন। এখন ফোন করে তাঁকে গান গাইতে ডাকেন অনেকেই। টাকার চুক্তিতে অনেক অনুষ্ঠানে গিয়ে গান গেয়ে দর্শক-শ্রোতা মাতিয়ে আসেন।
দিনাজপুরের বিরামপুর উপজেলার জোতবানি গ্রামের বাসিন্দা অছিম উদ্দীন মণ্ডল (৫১) জন্মান্ধ। কিন্তু কণ্ঠে তাঁর সুরের জাদু। সুরের দুনিয়ায় দোতারা তাঁর একমাত্র সঙ্গী। সম্প্রতি বিরামপুরে গিয়ে কথা হয় সুরের জাদুকর অছিম মণ্ডলের সঙ্গে। দুই কক্ষের একটি মাটির ঘরে এই বয়াতির বসবাস। স্ত্রী ও দুই মেয়ে নিয়ে তাঁর সংসার। ছোট মেয়ে শ্বশুরবাড়িতে। বড় মেয়ের স্বামীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে। এখন স্ত্রী ও বড় মেয়েটিকে নিয়ে কাটছে তাঁর জীবন।
উপজেলার দুর্গাপুর ঢিবি এলাকায় বসে এই প্রতিবেদকের কথা হয় অছিমের সঙ্গে। তিনি জীবনের গল্প শোনান। গল্প শোনান অন্ধত্ব থেকে সুরের আলোয় অবগাহনের। এ সময় অছিম খানিকক্ষণ গল্প করেন, খানিক বাদেই দোতারা বাজিয়ে ধরেন গান। সে গান তাঁর জীবনেরই কথা বলে।
অছিম মণ্ডলের বাবা নাজিমউদ্দীন ও মা সখিনা বেগম। ১৯৬৮ সালে জন্ম তাঁর। পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে অছিম দ্বিতীয়। জন্মের ঠিক দেড় বছরের মাথায় পরিবারের লোকজন প্রথম বুঝতে পারেন, অছিমের দুই চোখই আলোহীন। অভাবের সংসারে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী অছিম বেড়ে উঠতে থাকেন কিছুটা অনাদর আর অবহেলায়। তবে একটু বড় হতেই তাঁর গলা থেকে বেরিয়ে আসে মধুর সুর। গান শুনে মুগ্ধ হয়ে অনেকে খুশি হয়ে তাঁকে পুরস্কার দিতে শুরু করেন। কেউ বা চায়ের দোকান-হোটেলে নিয়ে অছিমকে খাওয়ান পেটপুরে। এদিকে অভাবের সংসারে লেখাপড়া আর শেখা হয় না তাঁর।
অছিম বলেন, একদিন চাচা কফিলউদ্দিন তাঁকে বলেন, ‘বেটা,তুই গানবাজনা শিখ। কিছু না হলেও অন্তত গানবাজনা করে খেতে পারবি।’ সেই চাচাই তাঁকে নিয়ে যান উপজেলার করমজি গ্রামে বাউলশিল্পী আবদুল হান্নানের কাছে। হান্নানের কাছে সংগীতের হাতেখড়ি হয় অছিমের।
১৯৮৯ সালের শেষের দিকে রংপুরের কাউনিয়ায় তিস্তা নদী ভাঙনে বাস্তুহারা হন বাউল হান্নান। এরপরই সপরিবার তিনি আসেন বিরামপুরের করমজি গ্রামে। অছিমের জীবনে ওস্তাদ হান্নান যেন ত্রাতার ভূমিকা নিয়ে আসেন। কিশোর অছিমকে ভালোবেসে তাঁর হাতে একটি দোতারা তুলে দেন হান্নান। বলেন, এতে সুর তুলতে পারলে কখনো ভাতের অভাব হবে না।
অছিম বলেন, এরপর তিনি গান শিখেছেন উপজেলার উদয়ন সংগীত ক্লাবে। সেখানে সংগীতগুরু গোপাল চন্দ্র রায়ের কাছে গান শেখেন চার বছর। গানের প্রতি তাঁর আগ্রহ দেখে উদয়ন ক্লাবে বিনা পয়সায় তাঁর গান শেখার ব্যবস্থা করেন গোপাল চন্দ্র রায়। তারপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁকে। দিনাজপুরের বিভিন্ন উপজেলা ও জেলা শহর, এমনকি পাশের জেলার সাংস্কৃতিক অঙ্গনেও ধীরে ধীরে পরিচিত ও জনপ্রিয় হয়ে উঠতে শুরু করেন। ইতিমধ্যে ২০ জনের বেশি শিষ্য তৈরি করেছেন তিনি। নিজ গ্রামে জোতবানি যুব উন্নয়ন সমিতিতে সন্ধ্যাবেলায় সংগীতচর্চার আসরে সংগীত অনুরাগীদের প্রায়ই গানের তালিম দেন।
অছিমের সংগীতজীবন শুরু হয়েছিল দোতারায় হাতেখড়ির মাধ্যমে। বয়স পঞ্চাশ পেরিয়ে অছিম এখন হারমোনিয়াম, বেহালা, বেঞ্জু, ঢোল, তবলা, বাঁশিসহ ১০টিরও বেশি যন্ত্রে পারদর্শী। তবে নিজের দোতারা ছাড়া আর কোনো যন্ত্র নেই। কারণ, যা উপার্জন করেন, তাতে ভাতের অভাব হয় না এ কথা ঠিক। কিন্তু অন্যান্য যন্ত্র কেনার সক্ষমতা তাঁর নেই।
শুনে শুনে গান মুখস্থ করেন বয়াতি অছিম। তিন শতাধিক গান মুখস্থ তাঁর। ভালোবাসেন লালন, বিজয় সরকার, লাল মিয়া বয়াতি, জালাল খাঁ, মাতাল রাজ্জাক আর মুজিব পরদেশীর গান। অছিম বলেন, ‘আমি মাটির মানুষ। মাটির গানই তো আমার পছন্দ হবে।’
অছিম ৩০টিরও বেশি জেলায় বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গিয়ে লোকসংগীত পরিবেশন করেছেন। টেলিভিশনের পর্দায় লোকসংগীত নিয়ে তাঁর ভাবনার কথাগুলো জানাতে চান দেশবাসীকে। দেশে ক্রমে লোকসংগীত ও লোক বাদ্যযন্ত্র হারিয়ে যাচ্ছে—এ নিয়েও তাঁর মনোতাপের শেষ নেই।
শিল্পী অছিম মণ্ডল সম্পর্কে জোতবানি গ্রামের প্রবীণ মুক্তিযোদ্ধা আবদুল গাফফার বলেন, ‘অভাবের সংসারে বেড়ে ওঠা অছিম গানের শিল্পী হিসেবে আমাদের এলাকার মানুষের কাছে খুবই জনপ্রিয়। এলাকার মানুষ সব সময় তাঁর পাশে ছিল, আছে, থাকবে।’