মাদারীপুরের শিবচর থেকে ভোরের দিকে পাঁচ বছরের শিশুসন্তানকে নিয়ে নরসিংদীর শিবপুরের উদ্দেশে রওনা হন দোলন চন্দ। আজ রোববার বেলা পৌনে একটার দিকে তাঁর সঙ্গে এই প্রতিবেদকের কথা হয় নরসিংদীর পাঁচদোনা মোড়ে। তিনি বলছিলেন, ‘ছুটির সময়টা বাবার বাড়িতে কাটাব বলে শিবচর থেকে কয়েক দফা ভেঙে ভেঙে যানবাহন পরিবর্তন করে এই পর্যন্ত এসেছি।’
কীভাবে এই পর্যন্ত আসলেন, জানতে চাইলে দোলন তাঁর যাত্রাপথের বর্ণনা দেন। তিনি বলেন, ‘শিবচর থেকে রওনা হয়েছি সেই ভোরবেলা। ফেরিঘাটে এসে দেখি ফেরি চলাচল বন্ধ। বাধ্য হয়ে ট্রলারে করে পদ্মা নদী পার হয়ে মাওয়া ঘাটে আসি। সেখান থেকে দুই দফা বাস পরিবর্তন করে নারায়ণগঞ্জের সাইনবোর্ড এলাকায় আসি। সেখান থেকে সিএনজিচালিত অটোরিকশায় করে নারায়ণগঞ্জের গাউসিয়া, তারপর বাসে নরসিংদীর পাঁচদোনা মোড়। এখান থেকে অটোরিকশা রিজার্ভ করে শিবপুরের লাখপুরের বাপের বাড়িতে যাব।’
দোলন চন্দ যখন রিজার্ভ করা অটোরিকশায় চড়ে বসেছেন, ঠিক তখন পাঁচদোনা মোড় এলাকায় বিভিন্ন বাস, মাইক্রোবাস, অটোরিকশা, মোটরসাইকেল, পিকআপ ভ্যান ডেকে ডেকে যাত্রী বোঝাই করছে। দোলনের মতো অনেকেই দূরের গন্তব্যে সরাসরি যানবাহন না পাওয়ায় ভেঙে ভেঙে যাচ্ছেন। স্বাভাবিকের চেয়ে দ্বিগুণ-তিন গুণ ভাড়ায় যাত্রী ওঠাচ্ছে এসব পরিবহন। এসব পরিবহনে চলাচল করা যাত্রীদের স্বাস্থ্যবিধি মেনে মাস্ক ব্যবহার করতে দেখা গেছে খুব কম।
এমনই আরেকজন আহামদ আলী। তিনি তাঁর পরিবারের পাঁচ সদস্য নিয়ে সিলেট যাচ্ছেন। চারটি ব্যাগ-ব্যাগেজ নিয়ে পাঁচদোনা মোড়ে অপেক্ষা করছিলেন ভৈরবের বাসের জন্য। তিনি বলেন, ‘সরাসরি বাস না পাওয়ায় আমাদের ভেঙে ভেঙে যেতে হচ্ছে। জেলার সীমানার আগে নামিয়ে দিচ্ছে যানবাহনগুলো। পরে রিকশায় বা হেঁটে কিছুদূর গিয়ে আবার যানবাহনে উঠতে হচ্ছে। এভাবে যাচ্ছি। ইদের ছুটিটা পরিবারের সঙ্গে কাটাতে চাই তাই এই কষ্টের যাত্রা।’
দুপুর ১২টা থেকে বেলা ২টা পর্যন্ত ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের মাধবদী থেকে জেলখানার মোড় এলাকায় নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে গণপরিবহন চলাচল করতে দেখা গেছে। ঈদে ঘরমুখী মানুষ বাস, মালবাহী ট্রাক, ব্যক্তিগত গাড়ি ও মাইক্রোবাসে করে নির্বিঘ্নে বাড়ি ফিরছেন। এসব এলাকায় তিনটি পুলিশ বক্স থাকলেও বেলা দুইটা পর্যন্ত গণপরিবহন বন্ধে পুলিশের কোনো তৎপরতা চোখে পড়েনি।
পাঁচদোনা মোড়ে গিয়ে দেখা যায়, শত শত ঘরমুখী মানুষের গাড়ির অপেক্ষা। এর মধ্যে যানবাহনের সহকারীদের বিভিন্ন গন্তব্যের নাম ধরে হাঁকডাক। পরে ভাড়া নিয়ে দর–কষাকষি শেষে গন্তব্যের উদ্দেশে রওনা। ভাড়ায় চালিত কিছু অটোরিকশা, মাইক্রোবাস ও বাস দাঁড়িয়ে থেকে যাত্রী বোঝাই করছে। পাশের একটি দোকানে তিনজন পুলিশ সদস্য বসে আছেন। অন্যদিকে ফারুক নামের একজন পুলিশ সদস্যকে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে কাজ করতে দেখা গেছে। বেলা একটার দিকে এক অটোচালক গাজীপুরের জয়দেবপুরের যাত্রী হাঁকছেন। ভাড়া ১২০ টাকা।
এক জেলা থেকে আরেক জেলায় অটোরিকশা যেতে দেয় কি না, জানতে চাইলে ফজলুর রহমান নামের ওই অটোচালক বলেন, ‘পেট গিয়ে পিঠে লেগে গেছে ভাই, কী করব আর। কিছু টাকা পুলিশকে ধরিয়ে দিলেই যেতে দেয়।’ এ সময় আটজন যাত্রী নিয়ে একটি মাইক্রোবাস ভৈরবের উদ্দেশে ছেড়ে যেতে দেখা যায়। ২ ঘণ্টা ধরে ওই মোড়ে অবস্থানের সময় আরও অন্তত ২০টি মাইক্রোবাসকে বিভিন্ন গন্তব্যে যাত্রী বোঝাই করতে দেখা গেছে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে ঢাকাগামী উত্তরা পরিবহন নামের যাত্রীবাহী একটি বাসচালক জানান, ‘সরকারি নিষেধাজ্ঞা থাকার পরও অনেকেই গাড়ি নিয়ে বের হয়েছে। তাই আমরাও গাড়ি নিয়ে বের হয়েছি। স্বাস্থ্যবিধি মানতে বাসে যাত্রীও কম নিচ্ছি। এখন পর্যন্ত সেভাবে পুলিশের কোনো বাধার সম্মুখীন হইনি।’ এ সময় বাইরে থেকে ছবি তুলতে গেলে করুণভাবে তাকিয়ে ছিলেন তিনি।
মো. আলমগীর নামের ব্রাহ্মণবাড়িয়াগামী এক যাত্রী বলেন, যেকোনো উপায়ে বাড়িতে পৌঁছাতে চান তিনি। দূরপাল্লার গন্তব্যে সরাসরি গণপরিবহন বন্ধ থাকায় ভাড়া বেশি লাগছে। তবু বাড়িতে যেতে পারলেই হয়।
পাঁচদোনা পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ উপপরিদর্শক ইউসুফ আহমেদ বলেন, সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী এক জেলা থেকে অন্য জেলায় গাড়ি চলাচল নিষেধ। যে বাসগুলো চলছে, তা জেলার ভেতরেই সীমাবদ্ধ থাকছে। জেলার সীমানা এলাকার ঘোড়াশাল, পুরিন্দা ও মাহমুদাবাদে পুলিশের চেকপোস্ট বসানো আছে। পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে এক জেলা থেকে অন্য জেলায় কোনো গণপরিবহন চলাচল করতে পারার কথা নয়।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সর্বশেষ প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, দেশের সব সড়ক-মহাসড়কে দূরপাল্লার পথে গণপরিবহন চলাচল বন্ধ। সরকারের এ সিদ্ধান্ত মাঠপর্যায়ে বাস্তবায়ন করার জন্য পুলিশ ও স্থানীয় প্রশাসনকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সরকার সর্বশেষ দফায় ৬ থেকে ১৬ মে পর্যন্ত জেলার ভেতর গণপরিবহন চলার সুযোগ দিয়ে শিথিলতা আনলেও দূরপাল্লার বাস চলাচলের অনুমতি দেয়নি।