'দুর্ভাগা জীবনসঙ্গীর জন্য ভীষণ কষ্ট হচ্ছে'
'ডাক্তার তিন মাস বাড়িতে থাকতে বলেছেন। ইতিমধ্যে তিন মাস শেষ হয়েছে। অবস্থা কেবলই খারাপের দিকে যাচ্ছে। পরিণতি আমি টের পাচ্ছি। তবে আরও কিছুদিন বেঁচে থাকলে ভালো লাগত। আমার অভাগা জীবনের দুর্ভাগা জীবনসঙ্গী–সহধর্মীনীর জন্য ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। মাত্র চার মাসের সংসার আমাদের। মেয়েটাকে আমি কিছুই দিতে পারিনি। ওকে জলে ভাসিয়ে দিয়ে যাচ্ছি। শুধু দিয়ে যাচ্ছি লাখ লাখ টাকা ঋণের বোঝা।'
কান্নাজড়িত কণ্ঠে মোবাইলের অপর প্রান্ত থেকে এমন হৃদয়ভাঙা বাক্যগুলো বলছিলেন—কোলন ক্যানসারে আক্রান্ত তরুণ কলেজশিক্ষক মো. রাকিবুল হাসান প্রধান (২৯)।
মাত্র দুই বছর আগেও টগবগে এই তরুণ রংপুর কারমাইকেল কলেজে ছাত্রাবস্থায় বিতর্কের মঞ্চ কাঁপিয়েছেন। কবিতা আবৃত্তি করে সবাইকে মুগ্ধ করেছেন। বন্ধুমহলে জমিয়েছেন আড্ডা। বিভিন্ন সাহিত্য ও সংস্কৃতি প্রতিযোগিতায় পেয়েছেন অনেক পুরস্কার। নিজ উদ্যোগে কলেজ ক্যাম্পাসে প্রতিষ্ঠা করেছেন কবিতাপ্রেমীদের নিয়ে সংগঠন 'আবৃত্তি সংসদ'। এসব এখন সোনালি অতীত। সব ছেড়ে রাকিব এখন জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে।
এই দুঃসময়ে আমার স্ত্রী পাশে থেকে সবসময় সেবা দিয়ে যাচ্ছে। বিনিময়ে আমি তাঁকে দিচ্ছি ঋণের দায়। এখন আমরা ৩ লাখ ৪০ হাজার টাকা ঋণগ্রস্ত। আমি বিদায় নেওয়ার আগে স্ত্রীকে এই ঋণের দায় থেকে মুক্ত করে যেতে পারলে স্বস্তি পেতামরাকিবুল হাসান প্রধান, ক্যানসারে আক্রান্ত তরুণ কলেজশিক্ষক
রাকিবের বড় ভাই নূরে আজম সিদ্দিকী রিওন বলেন, ছোট ভাইয়ের চিকিৎসার জন্য ১০ কাঠা জমি বিক্রি করেছেন। বন্ধক রেখেছেন ১৪ কাঠা জমি। এখন পর্যন্ত ১০ লাখ টাকার ওপরে খরচ হয়ে গেছে। এর মধ্যে ঋণ করতে হয়েছে প্রায় সাড়ে তিন লাখ টাকা। আরও যে কত খরচ হবে কে জানে?
পরিবার ও বন্ধু-স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ১৮ বছর আগে ব্রেস্ট ক্যানসারে রাকিবুলের মা মারা গেছেন। বাবাকে হারিয়েছেন নয় বছর আগে ২০১১ সালে। এরপর বড় হয়েছেন চাচার তত্ত্বাবধানে। তিন ভাইয়ের মধ্যে রাকিব মেজো। টানাপোড়েন সংসার সামলাতে ২০০৯ সালে এইচএসসি পাস করার পর গাজীপুরে কয়েক মাস পোশাক কারখানায় চাকরিও করতে হয়েছে তাঁকে। এরপর বাড়ি ফিরে ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে কারমাইকেল কলেজে প্রাণিবিদ্যা বিভাগে ভর্তি হন ২০১০–১১ শিক্ষাবর্ষে। টিউশুনি করে অনেক কষ্টে পড়ালেখা চালিয়ে গেছেন তিনি। অনার্স শেষ করে ২০১৮ সালের ১ জানুয়ারি তিনি রংপুরের ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল এ্যান্ড কলেজে (কলেজ শাখায়) জীববিজ্ঞানের প্রদর্শন শিক্ষক (ডেমোনেসট্রেটর) পদে যোগ দেন।
জীবনটাকে নতুন করে সাজানো স্বপ্ন যখন দেখছিলেন এই তরুণ। হঠাৎ তাঁর শারীরিক অসুস্থতা দেখা দেয়। চিকিৎসকের পরামর্শে বিভিন্ন পরীক্ষা–নিরীক্ষায় ২০১৯ সালের জুন মাসে তাঁর শরীরে কোলন ক্যানসার শনাক্ত হয়। প্রাথমিকভাবে চিকিৎসা চলে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। এরপর ঢাকার ইউনাইটেড হাসপাতাল ও বঙ্গবঙ্গু শেখ মুজিব মেডিকেলে। চিকিৎসা ও কেমোথেরাপি দিয়ে সুস্থও হয়েছিলেন। চিকিৎসক জানিয়েছিলেন, তিনি পুরোপুরি সুস্থ। শুধু তিন মাস পরপর চেকআপ করাতে হবে। সেটাই করে যাচ্ছিলেন। এরই মধ্যে চলতি বছরের ৩ এপ্রিল অনার্স চতুর্থবর্ষে পড়া এক তরুণীকে বিয়েও করেন এই কলেজশিক্ষক। বিয়ের পর ফের অসুস্থতা দেখা দেয়। আবার চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন। এবার অবস্থা আগের চেয়ে খারাপ। শরীরের ক্যানসার আরও বেশি ছড়িয়েছে। শুরু হয় তাঁর দুঃসহ–দুর্বিষহ দিন।
ঢাকার ইউনাইটেড হাসপাতালের ক্যানসার বিশেষজ্ঞ অসীম কুমার সেন গুপ্তের অধীনে চিকিৎসা নিয়েছেন রাকিব। তাঁর শারীরিক অবস্থা বিষয়ে গতকাল রোববার অসীম কুমার সেন প্রথম আলোকে বলেন, কোলন ক্যানসার তরুণদের ক্ষেত্রে মারাত্মক আকার ধারণ করে। ওই তরুণের (রাকিব) ক্ষেত্রে সেটাই হয়েছে। তিনি এখন ক্যানসারের লাস্ট স্টেজে। এই মহূর্তে নিরাময় হওয়া কঠিন। এই ধরনের রোগী কয়েক মাস থেকে বছর পর্যন্ত টেকে। তাঁর ক্ষেত্রে কী হবে বলা যাচ্ছে না। এখন বিভিন্ন সময় যে লক্ষণ দেখা দেবে— পেটে জ্বালাপোড়া, শরীর ব্যথা এসবের চিকিৎসা চালিয়ে যেতে হবে।
রাকিবের সহকর্মী মুরাদ হাসান বলেন, ছেলেটা (রাকিব) ভীষণ কর্মোদ্যমী, বিনয়ী ও হাস্যোজ্জ্বল। তাঁর তাত্ত্বাবধানে কলেজের মুবিন নামে এক শিক্ষার্থী জাতীয় পর্যায়ে একক বিতর্কে সারা দেশের মধ্যে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। এমন এক স্বপ্নবান তরুণ শিক্ষক ক্যানসারের সঙ্গে লড়ছেন। তাঁর চিকিৎসার জন্য সহকর্মী ও সাবেক বিতার্কিকেরা পাশে দাঁড়িয়েছেন। অন্যদেরও সহযোগিতার হাত বাড়ানো দরকার।
রাকিবের বাড়ি রংপুরের মিঠাপুর উপজেলার শঠিবাড়ীর শীতল গাড়ি গ্রামে। এখন নিজ বাড়িতেই তিনি ক্যানসারের সঙ্গে লড়ছেন। শরীর তাঁর ভীষণ দুর্বল। কাতর কণ্ঠে তিনি বললেন, ' ভাই রে, তিন মাস ধরে ঠিক মতো ঘুম নেই। আর এক মাস ধরে বিছানায় শুতেও পারি না, ঘুমাতেই পারি না। পেটে ভীষণ জ্বালাপোড়া করে, শরীরে ব্যথা করে শুয়ে থাকতে পারি না। এই দুঃসময়ে আমার স্ত্রী পাশে থেকে সবসময় সেবা দিয়ে যাচ্ছে। বিনিময়ে আমি তাঁকে দিচ্ছি ঋণের দায়। এখন আমরা ৩ লাখ ৪০ হাজার টাকা ঋণগ্রস্ত। আমি বিদায় নেওয়ার আগে স্ত্রীকে এই ঋণের দায় থেকে মুক্ত করে যেতে পারলে স্বস্তি পেতাম।'
স্বামীর বিষয়ে জানতে চাইলে রাকিবের নববধূ আসমাউল হুসনা রুমি মোবাইলের অপরপ্রান্ত থেকে শুধু বললেন, 'আমি আর কী বলব'। এরপর বুকফাঁটা চাপায় কান্নায় তাঁর কণ্ঠ থেমে গেল...
রাকিবের বিকাশ নম্বর: 01763-200962, 01774134248। ব্যাংক অ্যাকাউন্ট: MD. RAKIBUL HASSAN PRODHAN, 0007-0316007730, A5980241-A5980260, ট্রাস্ট ব্যাংক, রংপুর ক্যান্ট. শাখা।