‘পদ্মা নদী পার হওয়ার সময় গাড়ির ভেতর ঘুমিয়ে ছিলাম। হঠাৎ রাত সাড়ে তিনটার দিকে চিৎকার-চেঁচামেচি শুনে বেরিয়ে এসে দেখি, একটি ফেরি আমাদের ফেরিকে ধাক্কা দিচ্ছে। মুহূর্তের মধ্যে ফেরির একটি অংশ আমার গাড়ির ওপর উঠে যায়। গাড়ি চুরমার হয়ে যায়, আমি আহত হই। তখন দুটি ফেরিতেই বাতি বন্ধ ছিল।’
কথাগুলো বলছিলেন শিমুলিয়া–সাত্তার মাদবর মঙ্গলমাঝির ঘাট নৌপথে বেগম রোকেয়া ফেরিতে থাকা যাত্রী মো. রায়হান মিয়া। তিনি ঢাকা থেকে বেগম রোকেয়া ফেরিতে করে শিমুলিয়া থেকে জাজিরায় যাচ্ছিলেন। ফেরি পার হয়ে তাঁর মাদারীপুর যাওয়ার কথা ছিল।
ফেরিতে থাকা যাত্রী ও গাড়ির চালকেরা বলছেন, ফেরি দুটির নৌপথ দেখার সার্চলাইট জ্বালানো ছিল না। এ ছাড়া নৌপথে আলাদা কোনো আলোর ব্যবস্থা ছিল না।
গতকাল শনিবার গভীর রাতে শিমুলিয়া–সাত্তার মাদবর মঙ্গলমাঝির ঘাট নৌপথে দুই চলন্ত ফেরির মুখোমুখি ধাক্কায় রায়হান ছাড়াও নয়জন আহত হয়েছেন। নিহত হয়েছেন একজন গাড়িচালক। দিবাগত রাত সাড়ে তিনটার দিকে নৌপথের শরীয়তপুরের জাজিরা প্রান্তে টার্নিং পয়েন্টে ফেরি বেগম রোকেয়া ও সুফিয়া কামাল ফেরির মুখোমুখি ধাক্কার এ ঘটনা ঘটে।
নিহত ব্যক্তির নাম খোকন শিকদার (৪০)। তিনি ঝালকাঠির কাঁঠালিয়া উপজেলার চিংবাখালী এলাকার হারুন শিকদারের ছেলে। তিনি পিকআপ ভ্যানের চালক ছিলেন। বরিশাল থেকে মাছ নিয়ে ঢাকায় যাচ্ছিলেন। এ দুর্ঘটনা বেগম রোকেয়া ফেরিতে থাকা পিকআপ ভ্যানের চালক শামীম হোসেন মোল্যা নিখোঁজ রয়েছেন।
বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন সংস্থা (বিআইডব্লিউটিসি) ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ফেরি সুফিয়া কামাল ৩০টি যানবাহন নিয়ে শরীয়তপুরের সাত্তার মাদবর মঙ্গলমাঝির ঘাট থেকে মুন্সিগঞ্জের শিমুলিয়া ঘাটে যাচ্ছিল। একই নৌপথে ৩৪টি যানবাহন ও অর্ধশতাধিক যাত্রী নিয়ে সাত্তার মাদবর মঙ্গলমাঝির ঘাট অভিমুখে যাচ্ছিল ফেরি বেগম রোকেয়া। রাতে সাড়ে তিনটার দিকে দুটি ফেরি পদ্মা নদীর টার্নিং পয়েন্ট জাজিরা প্রান্তে পৌঁছালে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় দুটি ফেরি সামনের অংশ। বিকল হয়ে যায় বেগম রোকেয়া ফেরি গাড়ি ওঠানামার রেম্প। এ সময় সুফিয়া কামাল ফেরিতে থাকা একটি গাড়ির চাপায় পড়ে ঘটনাস্থলেই খোকন নিহত হন। পরবর্তী সময় সুফিয়া কামাল শিমুলিয়া ঘাটে ও বেগম রোকেয়া সাত্তার মাদবর মঙ্গলমাঝির ঘাটে পৌঁছে নোঙর করে রাখে। দুর্ঘটনার পর থেকে নৌপথটিতে ফেরি চলাচল বন্ধ রাখা হয়। সকাল ১০টার দিকে ফেরি চলাচল শুরু হয়। এতে ঘাটে যানজটের সৃষ্টি হয়।
প্রাইভেট কারের মালিক জাহিদ হাসান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের ফেরিটা পদ্মা নদী পারি দিয়ে জাজিরা প্রান্তে চলে এসেছিল। দুটি ফেরিতে বাতি বন্ধ থাকায় অন্ধকারে কিছু দেখা যাচ্ছিল না। এমন অবস্থায় দুটি ফেরিতে ধাক্কা লাগে। আমার গাড়িসহ কয়েকটি গাড়ি ভেঙে যায়। পরে শুনেছি সুফিয়া কামাল ফেরির একজন চালাক মারা গেছেন। আমাদের ফেরিতে থাকা একটি পিকআপের চালক নিখোঁজ।’
সুফিয়া কামাল ফেরির মাস্টার মোহাম্মদ হাসান বলেন, নদীতে প্রচণ্ড স্রোতে টার্নিংয়ে নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি। তাই আরেকটি ফেরির সঙ্গে ধাক্কা লাগে।
মাওয়া নৌ পুলিশ ফাঁড়ির উপপরিদর্শক মাহিদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ফেরি দুর্ঘটনায় নিহত ব্যক্তির লাশ সকালে উদ্ধার করা হয়েছে। তাঁর লাশ মাওয়া নৌ পুলিশ ফাঁড়িতে রয়েছে। আইনি প্রক্রিয়া শেষে লাশ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হবে। তবে কোনো যাত্রী নিখোঁজ রয়েছেন কি না, এখনো বলা যাচ্ছে না।
জানতে চাইলে বিআইডব্লিটিসির মাওয়া ঘাটের উপপরিচালক আহম্মদ আলী প্রথম আলোকে বলেন, নদীতে স্রোত থাকায় ফেরি চ্যানেলে ঘুরতে সমস্যা হয়। ওই কারণে দুটি ফেরির ধাক্কা লেগেছে। একজন গাড়িচালক মারা গেছেন। ঘটনাটি তদন্ত করা হচ্ছে।