দুই বছরে ৫২টি মেছো বাঘ ফিরে পেয়েছে স্বাভাবিক জীবন

সম্প্রতি এই মেছোবাঘটি উদ্ধার হওয়ার পর অবমুক্ত করা হয়েছে
ছবি: প্রথম আলো

জলবায়ু পরিবর্তন, পরিবেশ বিপর্যয়, আবাসস্থল নষ্ট হওয়া, খাদ্যসংকটসহ নানা কারণে মৌলভীবাজার জেলায় গ্রাম ও জনবসতির কাছে এসে প্রায়ই মেছো বাঘ ধরা পড়ে। আগে বন বিভাগ ধরা পড়া মেছো বাঘকে উদ্ধার করে নিয়ে এসে প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী লাউয়াছড়া ও হবিগঞ্জের সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানসহ বিভিন্ন সংরক্ষিত বনে অবমুক্ত করত। এতে প্রাণীটি নতুন স্থানে খাদ্যসংকটে পড়ত। পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে না পেরে সেটি আবার জনবসতির দিকে ফিরে আসত।

এই পরিস্থিতি এখন পাল্টেছে। উদ্ধার হওয়া মেছো বাঘ বা এর শাবককে সংরক্ষিত বনে আর ছাড়া হচ্ছে না। স্থানীয় মানুষজনকে বুঝিয়ে প্রাণীটিকে ধরা পড়ার স্থানেই অবমুক্ত করা হয়। এভাবে প্রায় দুই বছরে সিলেট বিভাগের বিভিন্ন স্থানে ধরা পড়া ৫২টি মেছো বাঘকে নিজ পরিবেশে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে।

বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, মেছো বাঘ বিড়ালজাতীয় প্রাণী। দেখতে অনেকটা বাঘের মতো হওয়ায় মেছো বাঘ নামে পরিচিত। এরা হাওর, জলাশয় ও জলাভূমির আশপাশের ঝোপঝাড়, নির্জন গোরস্থানের ঝোপঝাড় ও বাঁশঝাড়ে আবাস গড়ে। এসব স্থানেই চলাফেরা ও বাচ্চা প্রসব করে। কখনো ধানখেতে, সবজিখেতে এবং বাড়ির পরিত্যক্ত ঘরের কোণে আশ্রয় নেয়। জলাশয়ের দুর্বল ও রোগাক্রান্ত মাছ শিকার করে খায়। ধানখেতের জন্য ক্ষতিকর ইঁদুর শিকার করে। ফসল বাঁচায়। কৃষকের উপকার করে। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনসহ প্রাকৃতিক পরিবেশ বিপর্যয়, ঝোপঝাড় উজাড়, জনবসতির সম্প্রসারণের ফলে প্রাণীটির আবাসস্থল সংকুচিত হয়ে পড়েছে। খাদ্যসংকট সৃষ্টি হয়েছে। এতে করে মেছো বাঘের সংখ্যাও অনেক কমে গেছে।

এই প্রতিকূলতার মধ্যে টিকে থাকা অনেক মেছো বাঘ মানুষের তৈরি ফাঁদে ধরা পড়ছে। খাবারের সন্ধানে আসা মাছের খামার, হাঁস-মোরগের খামার ও বাড়িতে ফাঁদ দিয়ে মেছো বাঘ আটক করা হচ্ছে। কখনো কখনো ধানখেতে ফসল কাটার সময়ও ধরা পড়ছে মেছো বাঘের শাবক। অনেক সময় মানুষ আতঙ্কিত হয়ে মেছো বাঘকে মেরে ফেলছে। তবে বেশ কয়েক বছর ধরে সরকারি-বেসরকারি সংস্থার সচেতনতামূলক প্রচারণায় মানুষের মধ্যে বন্য প্রাণী সম্পর্কে সচেতনতা বেড়েছে। এখন আর মেছো বাঘকে পিটিয়ে মেরে ফেলা হচ্ছে না। ধরা পড়ার পর বন বিভাগকে খবর দেওয়া হয় এবং বন বিভাগ গিয়ে সেটিকে উদ্ধার করে নিয়ে আসে।

এ ক্ষেত্রে প্রচলিত নিয়মে বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলে ধরা পড়া মেছো বাঘকে লাউয়াছড়া, সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানসহ বিভিন্ন সংরক্ষিত বনে অবমুক্ত করা হয়ে আসছিল। এতে অবমুক্ত হওয়া মেছো বাঘ প্রায়ই খাদ্য ও পরিবেশসংকটে পড়ে। বন থেকে বেরিয়ে আবারও কারও না কারও হাতে ধরা পড়ে। তবে দুই বছর ধরে এই পরিস্থিতি পাল্টেছে। এখন আর জাতীয় উদ্যান বা সংরক্ষিত বনে মেছো বাঘকে অবমুক্ত করা হচ্ছে না। যে স্থানে ধরা পড়ছে, সেই এলাকার মানুষজনকে মেছো বাঘের উপকারী দিকগুলো সম্পর্কে ধারণা দেওয়া হচ্ছে। এরপর ধরা পড়ার স্থানেই অবমুক্ত করা হচ্ছে। এতে প্রাণীটি নিজের পরিবেশ ফিরে পাচ্ছে।

বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ সূত্র জানিয়েছে, ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২২ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত সিলেট বিভাগের বিভিন্ন স্থান থেকে ৫৯টি মেছো বিড়াল উদ্ধার করা হয়েছে। এর মধ্যে সাতটি মারা গেছে। জীবিত ৫২টিকে যেসব স্থান থেকে উদ্ধার করা হয়েছিল, সেখানেই অবমুক্ত করা হয়। এর মধ্যে ২৬টি ছিল মেছো বাঘের শাবক।

বন্য প্রাণী গবেষকদের মতে, সারা বিশ্বে মেছো বাঘ সংকটাপন্ন প্রাণী। আন্তর্জাতিক প্রকৃতি সংরক্ষণ সংস্থাগুলোর সংগঠন আইইউসিএন মেছো বাঘকে সংকটাপন্ন প্রাণী হিসেবে লাল তালিকাভুক্ত করেছে। মেছো বাঘ মানুষের কোনো ক্ষতি করে না। প্রাণীটি বাংলাদেশেও বিপন্ন। প্রাকৃতিক জলাভূমি কমার কারণে এদের জনসংখ্যা কমে আসছে।

বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের বন্য প্রাণী ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ কর্মকর্তা মির্জা মেহেদী সরোয়ার বৃহস্পতিবার প্রথম আলোকে বলেন, সংরক্ষিত বনে অবমুক্তির কারণে মেছো বিড়ালগুলো পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ত। খাদ্যসংকটসহ প্রজনন ও বংশবৃদ্ধি ব্যাহত হতো। বেশির ভাগ শাবককেই বাঁচানো যেত না। এখন যে এলাকা থেকে উদ্ধার করা হয় সেখানে অবমুক্ত করার ফলে এরা স্বাচ্ছন্দ্যে চলাফেরা, বসবাস ও প্রজননকাজ সম্পন্ন করতে পারছে। শাবকগুলো মায়ের কাছে পরম যত্নে বেড়ে উঠছে।

মির্জা মেহেদী সরোয়ার আরও বলেন, ‘এ বিষয়ে আমরা লিফলেট বিতরণসহ সচেতনতামূলক প্রচারণা চালাচ্ছি। এতে সাধারণ মানুষ প্রকৃতিতে এদের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করতে পারছেন, সচেতন হচ্ছেন।’