দুই বছর পর আখড়াবাড়িতে ফিরেছে প্রাণের স্পন্দন

করোনার কারণে দুই বছর বন্ধ থাকার পর আবারও লালনন স্মরণোৎসবে জড়ো হয়েছেন বাউল-সাধু ও ভক্তরা। আজ সন্ধ্যায় কুমারখালীর ছেঁউড়িয়ায়
ছবি: হাসান মাহমুদ

‘খুব কাইন্দিছি (কান্না), কবে যাব সাঁইজির ঘরে। আজ আশা পূরুণ হয়চে, এখন শান্তি লাগচে।’ কথাগুলো বলছিলেন কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলার ঘোড়ামারা এলাকার বাসিন্দা নজিরা ফকিরানী। ৭৫ বছরের অসুস্থ শরীর নিয়ে চাচাতো বোন বেগম ফকিরানীর সঙ্গে এসেছেন কুষ্টিয়ার ছেঁউড়িয়ায় লালনের আখড়াবাড়িতে।

আজ মঙ্গলবার বিকেলে আখড়াবাড়ির এক পাশে ক্লান্ত শরীরে পা মেলে বসে থাকা নজিরা বলেন, করোনায় দুই বছর বন্ধ ছিল সাঁইজির ঘর। এখন সব খোলা। একটু বিশ্রাম নিয়ে সন্ধ্যায় সাঁইজির চরণে ভক্তি দেবেন।

শুধু নজিরা-বেগমরাই নন, দীর্ঘ দুই বছর পর দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সাধু–ভক্তরা কুষ্টিয়ায় ছুটে এসেছেন। আসন পেতে খুঁজে ফিরছেন সাঁইজির প্রেম-ভালোবাসা। সাঁইজিকে আত্মায় ধারণ করার চেষ্টা করছেন তাঁরা। ফলে আখড়াবাড়িতে আবার ফিরেছে প্রাণের স্পন্দন।

আজ দুপুর থেকেই আখড়াবাড়ি চত্বরে জড়ো হতে থাকেন লালন–ভক্ত ও বাউলেরা
ছবি: প্রথম আলো

আজ সন্ধ্যায় কালী নদীর পাড়ে মূল মঞ্চে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সাইদুল ইসলামের সভাপতিত্বে তিন দিনের লালন স্মরণোৎসবের উদ্বোধন করেন খুলনা বিভাগীয় কমিশনার মো. ইসমাইল হোসেন। আলোচনা শেষে বাউলশিল্পীদের গান পরিবেশন শুরু হয়। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় এবং লালন একাডেমি ও জেলা প্রশাসনের আয়োজনে আজ এ উৎসব শুরু হলেও সাধু–গুরুদের প্রকৃত আচার শুরু হবে কাল বুধবার বিকেলে।

করোনাকালে মনের টান থাকলেও দুই বছর আখড়াবাড়িতে আসতে পারেনি লালন ভক্ত–অনুসারীরা। কেউ কেউ এসে প্রধান ফটকে ভক্তি দিয়ে চলে গেছেন। তাঁরা বলেন, দোলপূর্ণিমা তিথিতে লালন সাঁই এই আখড়াবাড়িতে তাঁর গুরু সিরাজ সাঁইয়ের কাছ থেকে দীক্ষা নিয়েছিলেন। তাই দিনটাকে আনন্দময় করে তুলতে প্রতি দোলপূর্ণিমা তিথিতে গানের আসর বসাতেন সাঁইজি। সেই থেকে শুরু। দিন যত যাচ্ছে, ভক্ত-অনুসারীদের ভিড় তত বেড়েছে। ছোট থেকে বৃদ্ধ—সবাই সাঁইজির টানে ছুটে আসছেন। গানে গানে তাঁকে মনে গেঁথে নিচ্ছেন।

কাল বিকেল চারটার পর অধিবাস দিয়ে অষ্টপ্রহর শুরু হবে জানিয়ে প্রবীণ ফকির নহির শাহ বলেন, ‘সাঁইজি তো হৃদয়ে গাঁথা। তাঁকে নিয়েই তো বেঁচে আছি। তবে সশরীর এসে ভক্তি দিতে পেরে মনে আলাদা শান্তি অনুভূত হচ্ছে।’

আজ দুপুর থেকেই আখড়াবাড়ি চত্বরে জড়ো হতে থাকেন সারা দেশ থেকে আসা বাউল, সাধু, ফকিরেরা। ছোট ছোট আসর বসা তাঁদের গানের আয়োজন ছিল কম। সাঁইজির ভক্তিতে ব্যস্ত ছিলেন তাঁরা। বছরখানেক পর অনেকের সঙ্গে দেখা হওয়ার আনন্দে মুখে ছিল হাসি।

সাধু–গুরুরা বলেন, দেখাদেখি, নিষ্পলক দৃষ্টিতে চাওয়া, একে অন্যের হৃদয় জানাজানি এবং শ্রদ্ধা-ভক্তি–ভালোবাসায় অন্যের সঙ্গে বিলীন হয়ে যাওয়া—এই চার প্রক্রিয়া গুরুর সান্নিধ্য পাওয়া। সেটাই করছেন তাঁরা।

সাধুসঙ্গ, বাউলগান আর তত্ত্ব আলোচনায় তিন দিন সময় পার করবেন বাউলেরা।