ঈদের দিন থেকে জমজমাট কক্সবাজারের চকরিয়া ডুলাহাজারা বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্ক। প্রতিদিন পাঁচ হাজারের বেশি দর্শনার্থী পার্ক ভ্রমণ করছেন। দর্শনার্থীদের নজর সিংহ, বাঘ, জেব্রা ও জলহস্তীর দিকে।
২০০১ সালের ১৯ জানুয়ারি ২ হাজার ২৫০ একর বনাঞ্চলে গড়ে তোলা হয় দেশের প্রথম এ সাফারি পার্ক। এর আগে ১৯৮০ সালে এটি ছিল হরিণ প্রজননকেন্দ্র। বর্তমানে পার্কের বিভিন্ন বেষ্টনীতে আছে সিংহ, বাঘ, জেব্রা, ওয়াইল্ড বিস্ট, জলহস্তী, ময়ূর, অজগর, কুমির, হাতি, ভালুক, হরিণ, লামচিতা, শকুন, কচ্ছপ, রাজধনেশ, কাকধনেশ, ইগল, সাদা বক, রঙ্গিলা বক, সারস, কাস্তেচরা, মথুরা, নিশিবক, কানিবক, বনগরুসহ ৫২ প্রজাতির ৩৪১টি প্রাণী। আর উন্মুক্তভাবে আছে ১২৩ প্রজাতির ১ হাজার ৬৫টি প্রাণী। এর মধ্যে গুইসাপ, শজারু, বাগডাশ, মার্বেল ক্যাট, গোল্ডেন ক্যাট, ফিশিং ক্যাট, খ্যাঁকশিয়াল, বনরুই উল্লেখযোগ্য।
ঈদের প্রথম দিন মঙ্গলবার বিকেলে পার্কে গিয়ে দেখা গেছে, বেশ কিছু দর্শনার্থী ৭৫ একরের সিংহবেষ্টনীতে ভিড় জমিয়েছেন। কারণ জানতে চাইলে উখিয়ার স্কুলশিক্ষক রমজান আলী বলেন, গত চার মাসে এই বেষ্টনীতে পরপর দুটি সিংহের মৃত্যু হয়েছে। গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে ছেলে সিংহের কামড়ে মা সিংহের মৃত্যু হয়েছে। এখন বেষ্টনীতে আছে তিনটি সিংহ। তাদের অবস্থা দেখতে এখানে এসেছেন তাঁরা।
গত ২৩ এপ্রিল টুম্পা, সম্রাট ও রাসেল নামের তিনটি সিংহকে রেখে মারা গেছে নদী নামের একটি সিংহ। ২৮ ফেব্রুয়ারি নদীর গলা ও পেটে কামড় বসিয়ে দেয় ছেলে সম্রাট নামের সিংহটি। টানা দুই মাস ধরে নদী কঠিন রোগে ভুগছিল। নদীর বয়স ১৫ বছর। একই বেষ্টনীতে ২২ বছর বয়সী আরেক সিংহ সোহেলের সঙ্গে ১১ বছরের সংসার ছিল নদীর। তাদের সংসারে জন্ম নেয় টুম্পা (১০) ও সম্রাট (৯) নামের দুই সন্তান। সোহেলের প্রথম সংসার ছিল হীরার সঙ্গে। হীরার পেটে জন্ম রাসেলের (১৫)। রাসেলকে রেখে বেষ্টনীতে মারা যায় হীরা। বেষ্টনীর একটি কক্ষে নদীর সঙ্গে থাকত সম্রাট। সম্পর্কে মা-ছেলে হলেও ঝগড়া-বিবাদেই কাটত তাদের সময়।
সিংহবেষ্টনীর পাশে ৮০ একরের বাঘবেষ্টনী। বেষ্টনীতে দৌড়ঝাঁপ করছিল জয়, জুঁই, আঁখি ও বড়ুয়া নামের চারটি বাঘ। দর্শনার্থীরা পাশে গেলে হুংকার ছাড়ে, মারে থাবা।
পার্কে ঢুকতে হাতের বাঁয়ে সরু রাস্তায় চোখে পড়ে অজগর, বানর, পাখিশালা, সাম্বার ও চিত্রা হরিণ এবং কুমিরবেষ্টনী। কুমিরবেষ্টনীর ওপর জরাজীর্ণ কাঠের সেতু। ওই সেতুতে উঠে কুমির দেখছেন দর্শনার্থীরা। সামনে কিছু দূর গেলে প্রায় ২০০ একরের বনাঞ্চল নিয়ে হাতিবেষ্টনী। দর্শনার্থীদের শিশুরা হাতির পিঠে উঠে ঘুরে বেড়ায় পার্কের এদিক–সেদিক। পাশে ১০ তলার একটি ওয়াচ টাওয়ার। আছে চারতলা ও দ্বিতলবিশিষ্ট আরও দুটি ওয়াচ টাওয়ার। তার পাশে জলহস্তীর বেষ্টনী। সেখানে দৌড়ঝাঁপ করছে ১০টি জলহস্তী।
পার্কের ডান দিকে ৩০ একরের পৃথক দুটি ভালুকের বেষ্টনী। সেখানে আছে ২২টি ভালুক। এখান থেকে পূর্বদিকে জেব্রাবেষ্টনী। জেব্রাগুলো একে অপরের সঙ্গে দিচ্ছে খুনসুটি। হরিণবেষ্টনীতে দেখা মেলে সাম্বার, মায়া ও চিত্রা হরিণের বিচরণ। দৌড়ঝাঁপ বেশ কিছু ভালুকের। কয়েকটি ভালুক গাছের ওপর থেকে হুংকার ছাড়ে দর্শনার্থীদের। হেঁটে পুরো পার্ক ঘুরতে সময় লাগে প্রায় পাঁচ ঘণ্টা।
পার্ক ঘোরার জন্য আছে একটি এসি ও দুটি নন–এসি বাস। বাসে পার্ক ঘুরতে সময় লাগে ৪৫ মিনিট। এসি বাসে জনপ্রতি ভাড়া ১০০ টাকা, নন–এসি বাসে ১৪ জন ৪০০ টাকা। পার্কে ৩০ কিলোমিটার সড়কের মধ্যে পাকা ১৮ কিলোমিটার।
পার্কে ঢুকতে টিকিট করতে হয়। প্রাপ্তবয়স্ক ৫০ টাকা, অপ্রাপ্তবয়স্ক (১৫ বছরের নিচে) ২০ টাকা। ১ থেকে ১০০ জনের শিক্ষার্থী দল ৫০০ টাকা ও ১০১ থেকে ২৫০ জন পর্যন্ত শিক্ষার্থী দলকে গুনতে হয় ৮০০ টাকা। সকাল নয়টা থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত খোলা থাকে পার্ক। বন্ধ থাকে সপ্তাহে এক দিন, মঙ্গলবার।
সাফারি পার্কের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. মাজহারুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ঈদের ছুটিতে কক্সবাজার সৈকত ভ্রমণে আসছে ১০ লাখের বেশি পর্যটক। স্থানীয় লোকজনের পাশাপাশি বিপুলসংখ্যক পর্যটক পার্ক পরিদর্শনে আসছে। আজ বুধবার ঈদের দ্বিতীয় দিন দর্শনার্থীর সংখ্যা আরও বাড়ছে।
পার্কের ইজারাদার ফজলুল করিম সাঈদী বলেন, করোনা মহামারি ও লকডাউনের কারণে প্রায় দুই বছর পার্কটি বন্ধ ছিল। গত বছরের ২০ আগস্ট থেকে পার্ক খুলে দেওয়ার হলেও দর্শনার্থী তেমন ছিল না। এ ঈদের ছুটিতে দর্শনার্থীর আগমন ঘটছে। দৈনিক গড়ে পাঁচ হাজার দর্শনার্থী পার্ক পরিদর্শনে আসছে, যার বেশির ভাগ স্থানীয় স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসার শিক্ষার্থী। পার্কের সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো গেলে দর্শনার্থীর সংখ্যা আরও বাড়বে।