তালপাতার পাখায় সাদাকালো জীবন

৫৭ বছর ধরে তালপাতার পাখা তৈরি করে সংসার চালাচ্ছেন খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার শোভনা মধ্যপাড়া গ্রামের সজেত শেখ
ছবি: প্রথম আলো

‘তোমার হাতপাখার বাতাসে প্রাণ জুড়িয়ে আসে...’ মো. রফিকুজ্জামানের লেখা গানটি বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছিল রিকশাচালক আকবরের কণ্ঠে। প্রযুক্তির এই যুগে বাতাসে প্রাণ জুড়াতে এসেছে নানান ধরনের বৈদ্যুতিক পাখা। তালপাতার পাখার বিকল্পও এসেছে। তবে এগুলো চাহিদা কমাতে পারেনি তালপাতার পাখার।

প্রায় ৫৭ বছর ধরে তালপাতার হাতপাখা তৈরি করছেন সজেত শেখ। এখন তাঁর বয়স ৬৬ বছর। ৯ বছর বয়স থেকে পাখা তৈরি শুরু করেছিলেন। তাঁর বাড়ি খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার শোভনা মধ্যপাড়া গ্রামে। বছরের প্রায় ৯ মাস তালপাতার পাখা বানান তিনি। বাকি ৩ মাস তৈরি করেন বাঁশের ঝুড়ি। আর এসব কাজে তাঁকে সার্বিকভাবে সহযোগিতা করেন তাঁর স্ত্রী ফাতেমা বেগম। পাখায় রঙের কাজ ও সেলাই করেন তাঁদের ১৬ বছরের এক নাতনি। মা–বাবা না থাকায় সজেত শেখের সংসারেই থাকে ওই নাতনি। পড়াশোনার পাশাপাশি নানা কাজে সহযোগিতা করে সে। পাখা তৈরি করে যা আয় হয়, তা দিয়ে চলে যায় ওই তিনজনের সংসার।

সম্প্রতি শোভনা মধ্যপাড়া গ্রামের পিচঢালা সড়ক দিয়ে যাওয়ার সময় চোখে পড়ে সজেত শেখের পাখা তৈরির দৃশ্য। বিভিন্ন জায়গা থেকে তালপাতা কেটে এনে সড়কের ধারে শুকাতে দিয়েছেন। পাশে থাকা ছোট একটি কুঁড়েঘরে বিশ্রাম নিচ্ছেন তিনি ও তাঁর স্ত্রী। ফাতেমা বেগমের হাতে থাকা তালপাতার পাখা দিয়ে পরম যন্ত্রে বাতাস করছেন রোদে পুড়ে কালো হওয়া সজেত শেখকে। দুজনের শরীরই জীর্ণশীর্ণ।

সজেত শেখ বলেন, তিনিই প্রথম ওই গ্রামে তালপাতার পাখা তৈরি শুরু করেন। তাঁর দেখাদেখি কাজ শুরু করেন আরও কয়েকজন। তবে তাঁর পরে শুরু করা সবাই মারা গেছেন। এখন আর কেউ ওই পেশায় নেই। শুধু তিনিই এখন তালপাতার পাখা তৈরি করছেন। প্রতিদিন ১০০টির মতো পাখা তৈরি করতে পারেন তিনি। পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছেন। সংসারে আর্থিক অনাটনের কারণে পড়াশোনা আর এগোয়নি। তবে ৯ বছর বয়সেই কীভাবে যেন তালপাতার পাখা তৈরি শিখে যান। এর পর থেকে তিনি ওই কাজই করছেন।

তালপাতার পাখার প্রধান উপাদান ছোট ছোট তালপাতা। বিভিন্ন গ্রাম ঘুরে ঘুরে ওই তালপাতা সংগ্রহ করেন। প্রতিটি তালপাতা কিনতে হয় ৫ থেকে ৭ টাকা দরে। পরে সেগুলো রোদে শুকাতে দেন। পাখার চারপাশ বাঁধানোর জন্য সূক্ষ্ম হাতে তৈরি করতে হয় বাঁশের চটার সরু লম্বা কাঠি। পাখাকে আকর্ষণীয় করতে ওই কাঠিতে আবার লাল, হলুদ, সবুজ রং লাগাতে হয়। এরপর হাতের কারিগরি কৌশলে তৈরি হয় তালপাতার পাখা।

তালপাতার পাখা তৈরির কাজে সজেত শেখকে সহযোগিতা করেন স্ত্রী ফাতেমা বেগম
ছবি: প্রথম আলো

তালপাতার পাখা অবশ্য দুই ধরনের। একটিতে সরাসরি তালপাতার ডাঁটা হাতল হিসেবে ব্যবহৃত হয়। অন্যটি তালপাতা কেটে বাঁশের চটা দিয়ে হাতল তৈরি করা হয়। তবে ডাঁটার হাতলওয়ালা পাখার কদর, চাহিদা ও দাম বেশি। সজেত শেখ বলেন, একসময় তালপাতার পাখার প্রচুর চাহিদা ছিল। কিন্তু বৈদ্যুতিক পাখার প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে এখন চাহিদা অনেক কমে গেছে। তারপরও তিনি যে পাখা তৈরি করেন, তা নিমেষেই বিক্রি হয়ে যায়। বাড়ি থেকে অনেক পাইকার কিনে নিয়ে যান, আবার নিজেও অনেক সময় পাখা নিয়ে চলে যান খুলনা শহরে। সেখানে বিভিন্ন দোকানে পাইকারি দামে তালপাতার পাখা বিক্রি করেন।

প্রতিটি তালপাতার পাখা তৈরি করতে খরচ হয় ১০ থেকে ১২ টাকা। সেটি পাইকারি বিক্রি করেন ২০ থেকে ২৫ টাকায়। ডুমুরিয়া উপজেলার বিভিন্ন বাজার ও খুলনা শহরের বিভিন্ন দোকান তাঁর কাছ থেকে পাখা নেয়। খুচরা বাজারে তালপাতার হাতপাখা বিক্রি হয় ৩৫ থেকে ৪০ টাকায়। সজেত শেখ বলেন, তালপাতার পাখা বিক্রি করে মাসে ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা আয় হয়। তা দিয়েই কোনোরকমে সংসার চলে যায়। নাতনির পড়াশোনার খরচ জোগাতে হয়। সব মিলিয়ে কোনোরকমে বেঁচে আছেন তাঁরা।

প্রায় ৫০ বছর আগে সজেত শেখের সঙ্গে বিয়ে হয় ফাতেমা বেগমের। বিয়ের পর স্বামীকে পেশা পরিবর্তন করতে বলেছিলেন, কিন্তু সজেত শেখ তা শোনেননি। এখন আর পেশা পরিবর্তন করতে বলেন না তিনি; বরং সজেত শেখকে সার্বিকভাবে সাহায্য করেন। ফাতেমা বেগম বলেন, বাজারে এখন তালপাতার পরিবর্তে প্লাস্টিকসহ বিভিন্ন ধরনের আধুনিক পাখা পাওয়া যায়। কিন্তু তালপাতার পাখার মতো এমন ঠান্ডা বাতাস কোনো কিছুতেই হয় না।

কথা বলতে বলতেই সেখানে হাজির হন সুকুমার জোয়ার্দার নামের এক ব্যক্তি। ওই উপজেলার মাগুরাঘোনা ইউনিয়নে বাড়ি তাঁর। চুকনগর বাজারে তাঁর একটি দোকান আছে। সেখানে তালপাতার পাখা বিক্রি করেন তিনি। সজেত শেখের কাছ থেকে তিনি পাইকারি দরে পাখা কিনতে এসেছিলেন। প্রায় ১০ বছর ধরে তিনি এভাবেই তালপাতার পাখা কিনছেন।