শিলিগুড়ির ট্রেনের সৈয়দপুরে যাত্রাবিরতি দাবি
স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে ঢাকা-শিলিগুড়ি (এনজেপি) রুটে চালু হচ্ছে আন্তর্দেশীয় ট্রেন। এতে বাংলাদেশ-ভারত দুই দেশে বয়ে যাচ্ছে আনন্দধারা। কিন্তু উত্তরাঞ্চলীয় ওই ট্রেনে উত্তরবঙ্গবাসীরই ভ্রমণের সুযোগ সংকুচিত বলে মনে করছেন এই অঞ্চলের মানুষেরা। উত্তরবঙ্গবাসীর সুবিধার কথা চিন্তা করে সৈয়দপুরে ট্রেনটির স্টপেজ দাবি করেছে নাগরিক আন্দোলন সংঘ সৈয়দপুর সিটি বাস্তবায়ন কমিটি। দাবি বাস্তবায়ন না হলে কাল-পরশুর মধ্যে বৃহত্তর আন্দোলনের কর্মসূচি পরিকল্পনা করেছে সংগঠনটি।
দাবির পেছনে সৈয়দপুর সিটি বাস্তবায়ন কমিটি বেশ কিছু যুক্তি হাজির করেছে। সংগঠনের নেতা-কর্মীরা এসব যুক্তি তুলে ধরছেন বিভিন্ন গণমাধ্যমের সাংবাদিকদের কাছে। কমিটির ভাষ্য, ঢাকা-এনজেপি আন্তর্দেশীয় ট্রেনটি চালু করা হচ্ছে ‘বৃহত্তর উত্তরবঙ্গে’ বসবাসকারী দুই দেশের মানুষের ভ্রমণ সুবিধার জন্য। পূর্ববঙ্গে পিতৃপুরুষের ভিটে ছিল এমন কয়েক লাখ মানুষ বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গের উত্তরবঙ্গে বসবাস করে। সাতচল্লিশের দেশভাগে যারা দুই দেশে ভাগ হয়ে যায়। ফলে সেখানে বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গের লাখ লাখ লোকের আত্মীয়স্বজন বসবাস করে। আবার বিপরীতভাবে ওই দেশের মানুষের আত্মীয়স্বজন এ দেশের উত্তরবঙ্গের জেলাগুলোতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। এ ছাড়া বৃহত্তরভাবে দুই দেশের মানুষের পারস্পরিক পর্যটন বাড়ানো, এ দেশের মানুষের পশ্চিমবঙ্গের উত্তরাঞ্চল, সিকিম, নেপাল, ভুটানসহ এলাকাগুলোতে ভ্রমণকে সহজ করে দেবে ঢাকা-এনজেপি এই রুটের ট্রেনগুলো। তবে তা ননস্টপ হিসেবে ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট স্টেশন থেকে যাত্রা শুরু করে গিয়ে থামবে শিলিগুড়ির নিউ জলপাইগুড়ি জংশন রেলস্টেশনে (এনজেপি)। মাঝে নীলফামারীর চিলাহাটিতে ট্রেনটি কয়েক মিনিটের জন্য দাঁড়াবে ট্রেনের চালক, গার্ড ইত্যাদি বদলের জন্য। তবে সেখানে কোনো যাত্রী তোলা হবে না।
উত্তরবঙ্গবাসীর সুবিধার কথা চিন্তা করে সৈয়দপুরে ট্রেনটির স্টপেজ দাবি করেছে নাগরিক আন্দোলন সংঘ সৈয়দপুর সিটি বাস্তবায়ন কমিটি। দাবি বাস্তবায়ন না হলে কাল-পরশুর মধ্যে বৃহত্তর আন্দোলনের কর্মসূচি পরিকল্পনা করেছে সংগঠনটি।
সৈয়দপুর সিটি বাস্তবায়ন কমিটি বলছে, রংপুর বিভাগের মানুষেরা এ ভ্রমণ সুবিধা নিতে যেতে হবে ৪০০ কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে ঢাকাতে। ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট স্টেশন ইমিগ্রেশনসহ যাবতীয় আনুষ্ঠানিকতা সারতে হবে। সেখানে এই ট্রেনে চড়ে জলপাইগুড়ি যেতে হবে আবার ফিরতি পথে সৈয়দপুর, পার্বতীপুর বাড়ির ওপর দিয়েই। উল্টোভাবে ভারত থেকে আসা লোকজনকেও উত্তরবঙ্গে আত্মীয়স্বজনের কাছে আসতে ঢাকায় নেমে দীর্ঘ পথ ঘুরে আসতে হবে। এই ভোগান্তি এড়াতে রংপুর বিভাগের আট জেলার মানুষের সুবিধার কথা চিন্তা করে সৈয়দপুরে ইমিগ্রেশন সুবিধাসহ ঢাকা-এনজেপি ট্রেনের একটি স্টপেজ দেওয়া উচিত হবে। এই রুটে ১৯৬৫ সালের আগে যখন ট্রেন চলত, তখন সৈয়দপুরে স্টপেজ ছিল।
রেলওয়ে সূত্র জানায়, পাকিস্তান আমলে ভারতীয় রেলের দার্জিলিং মেইল ও গোয়ালন্দ এক্সপ্রেস ট্রেন দুটি ভারতের শিলিগুড়ি থেকে চিলাহাটি স্থলবন্দর পেরিয়ে সৈয়দপুর স্টেশন হয়ে চলাচল করত। তখন সৈয়দপুর স্টেশনে কিছুক্ষণের জন্য যাত্রাবিরতি করত ট্রেনগুলো। ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় ওই ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। ভারতের হলদিবাড়ি স্টেশন থেকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের চিলাহাটি পর্যন্ত ১০ কিলোমিটার রেললাইন উপড়ে ফেলে উভয় দেশের কর্তৃপক্ষ।
মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে দেশ স্বাধীনের পর রংপুর অঞ্চলের মানুষ পুনরায় ওই রেলরুট চালু এবং চিলাহাটি স্থলবন্দর খুলে দিতে আন্দোলন করে আসছিলেন। সম্প্রতি উভয় দেশের কর্তৃপক্ষ চিলাহাটি-হলদিবাড়ি রেললাইন পুনঃস্থাপন করেছে। এরই মধ্যে ওই রেলপথে চলাচল করেছে ইঞ্জিন ও পণ্যবাহী ট্রেন। প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী ২৬ মার্চ ঢাকা-এনজেপি ট্রেন চালু হচ্ছে। বাংলাদেশ রেলওয়ে সূত্র জানায়, ট্রেনটি ঢাকায় যাত্রীদের যাবতীয় আনুষ্ঠানিকতা (ইমিগ্রেশন) সেরে সপ্তাহে দুই দিন জলপাইগুড়ির উদ্দেশে ছেড়ে যাবে। প্রায় সাড়ে ৫০০ কিলোমিটার দূরত্বের ওই রেলপথে ভারতীয় রেলেরও ট্রেন অনুরূপভাবে চলাচল করবে।
নীলফামারীর ওপর দিয়ে ভারত-বাংলাদেশের ট্রেন চলবে এ কথা শুনে আমরা আনন্দিত। আমরা আশা করেছিলাম, এই অঞ্চলের মানুষের ব্যবসা-বাণিজ্য ও পর্যটন খাতে ব্যাপক সুযোগ সৃষ্টি হবে। সে গুড়ে বালি। কেননা ট্রেনটিতে ভ্রমণ করতে চাইলে সাড়ে ৪০০ কিলোমিটার উল্টো পথে ঢাকায় যেতে হবে।
এদিকে জলপাইগুড়ির নাগরিক মঞ্চ নামের সীমান্তের ওই পাড়ের একটি সংগঠনও বাংলাদেশের সৈয়দপুর ও জলপাইগুড়িতে ওই ট্রেনের যাত্রাবিরতি দাবি করেছে। এ নিয়ে সেখানকার স্থানীয় পত্রপত্রিকায় ব্যাপক লেখালেখিও হচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ির জেলার পর্যটন ব্যবসায়ী সব্যসাচী রায় মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, রংপুর অঞ্চল থেকে প্রতিদিন বিপুলসংখ্যক পর্যটক ভারতের ডুয়ার্স, দার্জিলিংসহ এই অঞ্চলে বেড়াতে আসেন। এই অঞ্চলে তাঁদের আত্মীয়স্বজন রয়েছেন। অনুরূপভাবে রংপুর বিভাগের সব জেলাতেই রয়েছে এ অঞ্চলের মানুষের আত্মীয়স্বজন। এ কারণে যাত্রাবিরতি বা ইমিগ্রেশন কাজটি সৈয়দপুরের করার দাবি করেন তাঁরা।
নীলফামারী চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি সভাপতি মারুফ জামান কোয়েল বলেন, ‘নীলফামারীর ওপর দিয়ে ভারত-বাংলাদেশের ট্রেন চলবে এ কথা শুনে আমরা আনন্দিত। আমরা আশা করেছিলাম, এই অঞ্চলের মানুষের ব্যবসা-বাণিজ্য ও পর্যটন খাতে ব্যাপক সুযোগ সৃষ্টি হবে। সে গুড়ে বালি। কেননা ট্রেনটিতে ভ্রমণ করতে চাইলে সাড়ে ৪০০ কিলোমিটার উল্টো পথে ঢাকায় যেতে হবে। আবার তা ফিরে এসে নীলফামারীর ওপর দিয়ে যাবে। আমরা ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে নীলফামারীর সৈয়দপুরে ট্রেনটির স্টপেজ দাবি করছি।’
গত মাসে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব সেলিম রেজা ও মহাপরিচালক ধীরেন মজুমদার সৈয়দপুর রেলওয়ে স্টেশন পরিদর্শন করেছেন। এ সময় সৈয়দপুর রেলওয়ে স্টেশন আধুনিকায়নে দিকনির্দেশনা দেন। তবে আন্তর্দেশীয় ট্রেন সৈয়দপুরে থামার বিষয়ে কোনো আলোচনা হয়নি এবং এ–সংক্রান্ত কোনো চিঠিও পাইনি।
সৈয়দপুর সিটি বাস্তবায়ন কমিটির আহ্বায়ক তামিম রহমান বলেন, ‘আমাদের বুকের ওপর দিয়ে ধুলা উড়িয়ে ভারতে ট্রেন যাবে, তা হবে না। সৈয়দপুরে স্টপেজ দেওয়া না হলে আমরা কঠোর আন্দোলনে যাব।’
সৈয়দপুর রেলওয়ে স্টেশনমাস্টার শওকত আলী বলেন, ‘গত মাসে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব সেলিম রেজা ও মহাপরিচালক ধীরেন মজুমদার সৈয়দপুর রেলওয়ে স্টেশন পরিদর্শন করেছেন। এ সময় সৈয়দপুর রেলওয়ে স্টেশন আধুনিকায়নে দিকনির্দেশনা দেন। তবে আন্তর্দেশীয় ট্রেন সৈয়দপুরে থামার বিষয়ে কোনো আলোচনা হয়নি এবং এ–সংক্রান্ত কোনো চিঠিও পাইনি।’