ঠাকুরদাসী-আমেনাদের জীবনের শেষটাও সংগ্রামে মোড়ানো
দেশে তখন মুক্তিযুদ্ধ চলমান। ছোট্ট মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে শরণার্থী হিসেবে ঠাকুরদাসীও স্বামীর সঙ্গে পাড়ি জমান ভারতে। ঠাকুরদাসী তখন ছয় মাসের অন্তঃসত্ত্বা। শরণার্থী জীবনে তিনি যেমন পাওয়ার আনন্দে হেসেছেন আবার কাঁদতে হয়েছে হারানোর বেদনায়। আশ্রয়শিবিরে তাঁর কোলজুড়ে আসে এক পুত্রসন্তান। ধনুষ্টঙ্কারে হারিয়েছেন সঙ্গে নেওয়া মেয়েকে। মেয়ে হারানোর শোক কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই সিঁথির সিঁদুরও মুছে যায় ঠাকুরদাসীর। কাজে গিয়ে মারা যান স্বামী। দেশ স্বাধীনের পর ছেলেকে নিয়ে দেশে ফেরেন ঠাকুরদাসী।
এরপর ভৈরব-রূপসায় অনেক জল গড়িয়েছে। স্বাধীনতার সময় শুরু হওয়া সংগ্রাম জীবনসায়াহ্নে এসেও এখনো লড়ে যাচ্ছেন ঠাকুরদাসী রায়। শনিবার সকালে কচুশাক, কলার মোচা, থানকুনিপাতা আর তিত বেগুন বিক্রি করছিলেন ঠাকুরদাসী। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পূর্ব পাশে গল্লামারী লিনিয়ার পার্ক এলাকায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের বেড়িবাঁধে (হল রোড বাজার) প্রতিদিন ভোর থেকে শাকসবজি বিক্রি করেন তিনি। সেখানেই তাঁর সঙ্গে কথা হয়। জীর্ণশীর্ণ ও পোড় খাওয়া শরীর নিয়ে বসে থাকা ঠাকুরদাসী তাঁর বয়স ঠিক কত, তা বলতে পারলেন না। তবে মুক্তিযুদ্ধের সময়ের সঙ্গে তাঁর জীবনের ঘটনাপ্রবাহ মেলালে বয়স দাঁড়ায় সত্তরের কাছাকাছি।
ঠাকুরদাসী বললেন, ‘বয়স হয়ে গেছে ম্যালা। ছেলেকে প্যাটে নিয়ে আর মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে যুদ্ধের সময় ইন্ডিয়া গেছি। সেখানে গিয়ে তো সব হারালাম। একসঙ্গে ইন্ডিয়ার উদ্দেশে রওনা হলেও ওপারে গিয়ে বাবা-মাকে খুঁজে পাইনি। পরে জানতি পারি, তারা বিহার ক্যাম্পে গেছে। বাবারা কোনো দিন আর দেশে ফেরেনি। আমি কাকার পরিবারের সঙ্গে দেশে আসি।’
ঠাকুরদাসীর বাপের বাড়ি খুলনার বটিয়াঘাটার নিজখামার গ্রামের দত্তবাড়ি। বিয়ে হয় একই উপজেলার হোগলাডাঙ্গা গ্রামের বৈরাগীবাড়ি। তবে যুদ্ধের পর দেশে ফিরে সরকারি পরিচয়পত্রে নাম লেখানোর সময় বাবা ও স্বামীর পদবি হারিয়ে খাতাকলমে নাম ঠাকুরদাসী রায় হয়ে যায়।
ঠাকুরদাসী রায় প্রথম আলোকে বলেন, একজীবনে তিনি প্রচুর কষ্ট করেছেন। যুদ্ধ-পরবর্তী দেশে ফিরে বাবার বাড়িতে ঠাঁই হয় তাঁর। তখন সবারই কষ্ট। কেউ কাউকে ভালোভাবে দেখার উপায় ছিল না। ছোট্ট ছেলেকে কাকির কাছে রেখে সারা দিন বিভিন্ন জায়গায় দিনমজুরির কাজ করতেন তিনি।
ছেলের একার খাটনিতে সংসার চলে না। তাই ছেলেকে একটু সাহায্য করি। বউমাও মাঝেমধ্যে বাইরে কাজ করে। জীবনভর খেটে গেছি, বসে থাকতেও পারি না। বসে থেকে কী লাভ! কাজ করে খেলে শরীরও ভালো থাকে।
ঠাকুরদাসী এখন ছেলে নলিনী রায়ের কাছেই থাকেন। অন্যের জমি বর্গা চাষের পাশাপাশি দিনমজুরের কাজ করেন ছেলে। কোনোমতে চলা ছেলের সংসারে আরেকটু সচ্ছলতা আনতে এই বয়সেও পরিশ্রম করে যাচ্ছেন তিনি। প্রতিদিন ভোরে নিজখামার থেকে হল রোডের বাজারে যান। সকাল ১০টা থেকে সাড়ে ১০টার মধ্যে বেচাবিক্রি শেষ করে বাড়িতে চলে আসেন। এরপর সারা দিন পরের দিনের জন্য শাকসবজি সংগ্রহ করেন। কোনো দিন ৫০ টাকা আবার কোনো দিন ১৫০ টাকার মতো শাকসবজি বিক্রি হয় তাঁর।
ঠাকুরদাসী বলেন, ‘ছেলের একার খাটনিতে সংসার চলে না। তাই ছেলেকে একটু সাহায্য করি। বউমাও মাঝেমধ্যে বাইরে কাজ করে। জীবনভর খেটে গেছি, বসে থাকতেও পারি না। বিক্রি করে যা হয়, তা দিয়ে একটা মাছ কিনে নিয়ে গেলাম, না হয় একটু তরকারি কিনলাম। একটা নাতি আছে, তার হাতে দুটো পয়সা দিলাম। বসে থেকে কী লাভ! কাজ করে খেলে শরীরও ভালো থাকে।’
হল রোডের ওই বাজারের বিক্রেতা মূলত গ্রামের নারী-পুরুষেরা। বটিয়াঘাটা ও ডুমুরিয়ার বিভিন্ন গ্রামের মানুষ বাড়ির টাটকা দেশি ফল, ডিম, কলা, দুধ, সবজি, শাকপাতা, চুইঝাল ইত্যাদি বাজারে এনে বিক্রি করেন। যাঁরা দেখেশুনে গ্রামের টাটকা জিনিস কিনতে চান, তাঁরাই মূলত ওই বাজারের ক্রেতা।
ঠাকুরদাসীর ঠিক পাশেই শাক বিক্রি করছিলেন আমেনা বেগম (৬২)। আমেনার বাড়ি ছিল পাইকগাছা উপজেলার সোলাদানা ইউনিয়নের পাটকেল পোতা গ্রামে। নিজেদের জমিজায়গা ছিল না। নদীর তীরে ঘর তুলে থাকতেন। কিন্তু ঘূর্ণিঝড় আইলার সময় সবকিছু ভেসে যায়। এরপর রাস্তার পাশে তাঁবুর মধ্যে কয়েক মাস বসবাস করেন তাঁরা। তারপর স্বামীর সঙ্গে মেয়ে, দুই ছেলেকে নিয়ে খুলনা শহরে চলে আসেন। সময়ের ফেরে ছেলেমেয়েদের বিয়ে হয়ে গেছে। আমেনা থেকে গেছেন আগের মতো।
কথায় কথায় আমেনা জানালেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের উত্তর পাশের এলাকায় স্বামীর সঙ্গে থাকতেন। একটা গরুর খামার দেখাশোনা করতেন। আট মাস আগে ক্যানসার কেড়ে নিয়েছে স্বামীকে। মালিকের গরুর খামারটি এখন আর নেই। তবু সেখানেই থাকছেন আমেনা। এ জন্য মালিককে ভাড়া বাবদ কিছুই দিতে হয় না তাঁর।
আমেনা বেগম প্রথম আলোকে বলেন, ‘ছেলেদের আলাদা সংসার হয়েছে। তাদের কোলের কাছে থাকতে ইচ্ছে করে না। যে কয়দিন বাঁইচে থাকি, কষ্ট কইরে খাব। যে কয়দিন বাঁচি, নিজের মতো করে চলব। ভার্সিটির মধ্যে থেকে শাকপাতা বেচে খাই। প্রতিদিন ২০০ টাকার মতো বিক্রি হয়। সকালে কিছু খাই না। আজ দুপুরের রান্না কাল দুপুর পর্যন্ত যায়। একা মানুষ চলে যায়।’