‘টিসিবির লাইনে দাঁড়িয়ে গচ্চা গেল এক দিনের রোজগার’

দীর্ঘ সময় ধরে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকার পর টিসিবির পণ্য নিয়ে ফিরছেন এক নারী। আজ দুপুরে নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার ফতুল্লার দাপা ইদ্রাকপুরের হক স্টিল মিল এলাকায়
ছবি: প্রথম আলো

৫৫ বছর বয়সী দুলাল হোসেন রাজমিস্ত্রির কাজ করেন। সংসারে স্ত্রী, এক ছেলে ও এক মেয়ে। কাজ করলে প্রতিদিন তাঁর আয় হয় ৫০০ টাকা। সকাল সাড়ে সাতটায় টিসিবির পণ্য কিনতে লাইনে দাঁড়িয়েছেন তিনি। বেলা পৌনে একটার দিকে পণ্য হাতে পেয়েছেন। এভাবে কম দামে পণ্য নিতে এসে এক দিন কর্মহীন থাকতে হয়েছে তাঁকে।

দুলাল হোসেন নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার ফতুল্লার দাপা এলাকায় পরিবার নিয়ে ভাড়া থাকেন। তিনি বলেন, কিছু টাকা বাঁচাতে লাইনে দাঁড়িয়ে গচ্চা গেল এক দিনের রোজগার।

আজ রোববার বেলা ১১টা থেকে নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার ফতুল্লার দাপা ইদ্রাকপুর এলাকার হক স্টিল মিল এলাকায় টিসিবির পণ্য বিক্রি কার্যক্রমের উদ্বোধন করেন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব তপন কান্তি ঘোষ। পবিত্র রমজান উপলক্ষে নিম্ন আয়ের মানুষের কাছে ভর্তুকি মূল্যে এ পণ্য বিক্রি করা হচ্ছে।

এর আওতায় দুই কেজি সয়াবিন তেল (প্রতি কেজি ১১০ করে) ২২০ টাকায়, দুই কেজি মসুর ডাল (প্রতি কেজি ৬৫ টাকা) ১৩০ টাকায় ও দুই কেজি চিনি (প্রতি কেজি ৫৫ টাকা) ১১০ টাকায় দিচ্ছে টিসিবি। খুচরা বাজারে প্রতি কেজি সয়াবিন তেল ১৭০ টাকা, প্রতি কেজি মসুর ডাল ১৩৫ টাকা এবং চিনি প্রতি কেজি ৮০ টাকায় বিক্রি করা হয়।

ফতুল্লার স্টেশন রোড এলাকার মিনারা বেগম। ১৫ বছর আগে স্বামীকে হারিয়েছেন। ২০ বছর বয়সী একমাত্র প্রতিবন্ধী সন্তান নিয়ে তাঁর সংসার। কলা ও কাঁচা সবজি বিক্রি করেন মিনারা বেগম। প্রতিদিন দোকান থেকে আয় হয় ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা।

টিসিবির পণ্য নিতে সকাল থেকে আধাবেলা দোকান বন্ধ রাখতে হয়েছে তাঁর। মিনারা বেগম বলেন, ‘অনেক কষ্টে প্রতিবন্ধী সন্তান নিয়ে সংসার চালাই। দুপুর পর্যন্ত দোকান বন্ধ রাখায় একবেলা বেচাকেনা হয়নি। লাভ করতে গিয়ে লোকসানই হয়ে গেল।’

রাতে ডাইং কারখানায় নাইট ডিউটি শেষ করে সকাল সাতটার দিকে টিসিবির পণ্য নিতে লাইনে দাঁড়িয়েছিলেন লিটন দে। দুই মেয়ে, এক ছেলেসহ পাঁচজনের সংসার। দুপুর সাড়ে ১২টায় পণ্য হাতে পাওয়ার পর লিটন বলেন, ‘ভেবেছিলাম এখান থেকে চাল, পেঁয়াজসহ অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যও পাব। এভাবে সকাল থেকে দাঁড়িয়ে থেকে খুব একটা লাভ হলো না।’

হক স্টিল মিল এলাকার মাঠে সরেজমিনে দেখা গেছে, সকাল সাতটা থেকে শত শত নারী–পুরুষ লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন। প্যান্ডেলের ভেতরে বাঁশ দিয়ে পুরুষ ও নারীর আলাদা লাইন তৈরি করা হয়েছে। তবে ব্যবস্থাপনা ধীরগতির হওয়ায় পণ্য দিতে দেরি হচ্ছিল। এ জন্য প্রচণ্ড গরমে ভোগান্তি পোহাতে হয় পণ্য নিতে আসা নারী-পুরুষকে। অনেককে রোদে বাধ্য হয়ে লাইনের মধ্যে বসে পড়তে দেখা গেছে।

দাপা ইদ্রাকপুর এলাকার রফিক আহম্মেদ উচ্চ রক্তচাপের রোগী। তিনি বলেন, ‘টাকা দিয়ে পণ্য কিনতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা রোদে দাঁড়িয়ে আছি। এর আগে তিনবার ধরনা দিছি ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) অফিসে। ভোটার আইডি কার্ড ও তিন কপি ছবিও দিছি। ইউপি সদস্য হলুদ কার্ড দিছে। হলুদ কার্ড নিয়ে ফাইনাল স্লিপ দিছে। এখন দেহি পণ্য পাইতেও ভোগান্তি।’

রেলস্টেশন এলাকার আলেয়া বেগমের স্বামী অটোরিকশাচালক। এক মেয়ে, দুই ছেলেসহ পাঁচজনের সংসার তাঁদের। মেয়ে সরকারি তোলারাম কলেজে উচ্চমাধ্যমিকে পড়াশোনা করছেন। তিনি বলেন, ‘বাজারে সব জিনিসের দাম বেশি। এখানে চাল দিলে বেশি ভালো হতো।’

বেলা দুইটার দিকে টিসিবির পণ্য শেষ হয়ে যায়। এর ফলে সকাল থেকে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা ৩০ জন নারী-পুরুষকে খালি হাতে ফেরত যেতে হয়। এ সময় ক্ষোভ প্রকাশ করেন তাঁরা।

ফতুল্লা স্টেশন এলাকার হাফেজা আক্তার বলেন, ‘প্রচণ্ড রোদে চার ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থেকেও পণ্য পাইনি। এখানে মালামাল শেষ। তাই আমাদের অন্য জায়গায় যেতে বলেছে।’

কাঠেরপুর টাইম সোয়েটার কারখানায় কাজ করেন অরফুন বিবি। তাঁর বাড়ি দাপা ইদ্রাকপুর এলাকায়। তিনি বলেন, ‘সকাল ১০টায় কারখানা থেকে ছুটি নিয়ে কম দামে পণ্য কিনতে এসেছিলাম। কিন্তু পাইনি। সারাটা দিনই মাটি হয়ে গেল।’

এ বিষয়ে কথা হয় টিসিবির ডিলার আলী নূর ট্রেডার্সের মালিক আক্তার হোসেনের সঙ্গে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ৬১০ জনের মাল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল। সেগুলো বিতরণ করা হয়েছে। ২০-৩০ জনের মতো পাননি। তাঁর ধারণা, অন্য সেন্টারের লোকজন কিউআর স্লিপ নিয়ে এসে তাঁদের এখান থেকে মাল নিয়ে গেছেন। এ কারণে সংকট তৈরি হয়েছে।

জানতে চাইলে নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রিফাত ফেরদৌস প্রথম আলোকে বলেন, সাতটি ইউনিয়নে ৪ হাজার ৬৫৫ জনকে পণ্য বিতরণ করা হয়েছে। কিউআর স্লিপ ছাড়া কাউকে পণ্য দেওয়া হয়নি।

তিনি বলেন, প্রথম দিন হওয়ায় পণ্য বিতরণে একটু সমস্যা হয়েছে। পরবর্তী সময়ে এই সমস্যা থাকবে না।