টানা বৃষ্টি ও জোয়ারে ভেসে গেছে ১৭ হাজার ঘের-পুকুরের মাছ
টানা বৃষ্টি ও পূর্ণিমার জোয়ারের পানিতে বাগেরহাটের ১৭ হাজার ঘের ও পুকুরের মাছ ভেসে গেছে। এতে মৎস্য চাষিদের আর্থিক ক্ষতি ১১ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে বলে ধারণা করছে জেলা মৎস্য বিভাগ। তিন দিন ধরে চলা টানা বৃষ্টিতে জেলার রামপাল, মোংলা, শরণখোলা, মোরেলগঞ্জ ও বাগেরহাট সদর উপজেলায় সবচেয়ে বেশি মাছের ঘের ভেসে যাওয়ার খবর পাওয়া গেছে। জেলায় মৎস্য খাতের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ গত মে মাসে আঘাত হানা ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের চেয়ে বেশি হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
জেলা মৎস্য বিভাগের হিসাব অনুযায়ী, জেলায় ছোট-বড় মিলিয়ে মোট ৬৭ হাজার মাছের ঘের রয়েছে। চলতি অর্থবছরে ৩৩ হাজার মেট্রিক টন মাছ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। এর মধ্যে গতকাল বৃহস্পতিবার পর্যন্ত টানা তিন দিনের বৃষ্টিতে বিভিন্ন উপজেলার ১৭ হাজার ৩৭৫ মাছের ঘের ও পুকুর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।এর মধ্যে ৭ হাজার ৪৩৪টি পুকুর, ৯ হাজার ৬৬৪টি ঘের এবং ২৭৫টি কাঁকড়া-কুঁচিয়ার খামার রয়েছে। বৃষ্টি অব্যাহত থাকায় ক্ষতি আরও বাড়ার আশঙ্কা করছেন তাঁরা।
ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের সময় মোরেলগঞ্জের বহরবুনিয়া এলাকার শেখ হুমায়ুন কবিরের দেড় শ বিঘার ঘের তলিয়ে সব মাছ ভেসে গিয়েছিল। ক্ষতি কাটাতে কিছুদিন পর ঘেরে আবার সাদা মাছ ও বাগদার পোনা ছাড়েন তিনি। কিন্তু এবারের টানা বৃষ্টিতে আবার তাঁর ঘের ভেসে গেছে বলে জানান তিনি।
লবণাক্ততার কারণে জেলায় ধানের ফলন কম হওয়ায় এবং চিংড়ি চাষে সাফল্যের কারণে গত চার দশকের বেশি সময় ধরে জেলার মানুষ মাছ চাষের দিকে ঝুঁকেছে। করোনা পরিস্থিতির কারণে চিংড়ি, কাঁকড়া ও কুঁচিয়া রপ্তানি কমে যাওয়ায় এমনিতেই বিপাকে পড়েছিলেন জেলার মৎস্য চাষিরা।
এর ওপর সাম্প্রতিক সময়ে ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের ধাক্কা সামলে উঠার আগেই আবার বড় ক্ষতির মুখে পড়লেন তাঁরা। ইয়াসের প্রভাবে সৃষ্ট জোয়ারে জেলার ৪ হাজার ২৬৭টি মাছ ও কাঁকড়ার ঘের ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। সে সময় চাষিদের প্রায় ৭ কোটি টাকার ক্ষতির হিসাব করেছিল জেলা মৎস্য বিভাগ।
জেলার রামপাল উপজেলার বাঁশতলী গ্রামের মাছচাষি মোস্তাফিজুর রহমান ৫০ বিঘা জমিতে মাছের চাষ করেন। টানা বৃষ্টিতে তাঁর ঘের তলিয়ে যাওয়ায় অধিকাংশ মাছ বের হয়ে গেছে। তিনি বলেন, ‘আমরা জাল দিয়ে ঘেরের পাড় ঘিরে দেওয়ার চেষ্টা করেছি। কিন্তু পানির চাপ এত বেশি ছিল যে আমরা সব মাছ রক্ষা করতে পারিনি। আমার অন্তত ১০ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে।’
ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের সময় মোরেলগঞ্জের বহরবুনিয়া এলাকার শেখ হুমায়ুন কবিরের দেড় শ বিঘার ঘের তলিয়ে সব মাছ ভেসে গিয়েছিল। ক্ষতি কাটাতে কিছুদিন পর ঘেরে আবার সাদা মাছ ও বাগদার পোনা ছাড়েন তিনি। কিন্তু এবারের টানা বৃষ্টিতে আবার তাঁর ঘের ভেসে গেছে বলে জানান তিনি।
বাগেরহাট জেলা চিংড়ি চাষি সমিতির সভাপতি ফকির মহিতুল ইসলাম বলেন, ‘টানা বৃষ্টিতে অনেক পুকুর ও ঘেরের মাছ ভেসে গেছে। এই ক্ষতি অবর্ণনীয়। চিংড়ি উৎপাদন ও দেশের রপ্তানি আয়ের ক্ষেত্রে বাগেরহাট জেলা বড় ভূমিকা রাখে। আমাদের বেশির ভাগ চাষিই ব্যাংক ও এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে মাছের চাষ করে থাকেন। এই খাতকে টিকিয়ে রাখতে এখন সরকারের সাহায্য দরকার।’
গত তিন দিনের অতিবৃষ্টি ও প্রবল জোয়ারের পানিতে জেলার ৭৫টি ইউনিয়নের মধ্যে ৪৭ ইউনিয়নের মাছের ঘের পানিতে ভেসে গেছে। এর মধ্যে সাড়ে ৭ হাজার পুকুর, সাড়ে ৯ হাজারের ওপর চিংড়ির ঘের রয়েছে।এ এস এম রাসেল, বাগেরহাট জেলা মৎস্য কর্মকর্তা
পানিনিষ্কাশনের খালগুলো দখল–ভরাট ও মাছ চাষ করতে গিয়ে সব প্লাবন ভূমিগুলো নষ্ট করা হয়েছে বলে মনে করেন ফকির মহিতুল ইসলাম। ফলে অতিরিক্ত জোয়ার বা বৃষ্টির পানিতে জলবদ্ধতা দেখা দিচ্ছে। তিনি বলেন, আগে বিল ও মাঠগুলোতে হাজার হাজার কিউসেক পানি জমা হতো।অপরিকল্পিত চিংড়ি চাষ, বাঁধ দেওয়া ও দখলের ফলে চাষিরা নিজেরাই নিজেদের বিপদ ডেকে এনেছেন। এর সঙ্গে প্রকৃতির বৈরী আচরণও এখন যোগ হয়েছে। তাই এই অঞ্চলের মানুষের জন্য একটি সমন্বিত পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন জরুরি বলে মনে করেন তিনি।
বাগেরহাট জেলা মৎস্য কর্মকর্তা এ এস এম রাসেল বলেন, গত তিন দিনের অতিবৃষ্টি ও প্রবল জোয়ারের পানিতে জেলার ৭৫টি ইউনিয়নের মধ্যে ৪৭ ইউনিয়নের মাছের ঘের পানিতে ভেসে গেছে। এর মধ্যে সাড়ে ৭ হাজার পুকুর, সাড়ে ৯ হাজারের ওপর চিংড়ির ঘের রয়েছে। সব মিলিয়ে ঘের ভেসে প্রায় ১১ কোটি টাকার ক্ষতির হিসাব পাওয়া গেছে। তবে বৃষ্টি অব্যাহত থাকলে ক্ষতির পরিমাণ আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন তিনি।