এক বছর আগের ঠিক এই দিনে সরগরম ছিল গুলশানের হোলি আর্টিজান বেকারি। সারা দিন দেশি-বিদেশি ক্রেতার যাতায়াত ছিল বেকারিতে। সামনের সবুজ লনে অনেকেই মেতে উঠেছিলেন আড্ডায়। কিন্তু এক দিন পর ১ জুলাইয়ের রাত পাল্টে দিল বাংলাদেশের চিত্র। হোলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলায় দেশি-বিদেশি নাগরিকদের নিহত হওয়া, দেশের তরুণদের কারও কারও এই অপরাধে জড়িত থাকা, আতঙ্ক, অবিশ্বাস, ভয়, নিরাপত্তাহীনতা, বিষাদ—সব মিলিয়ে দম বন্ধ হওয়া এক পরিস্থিতি। পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র—সবই যেন থমকে গিয়েছিল।
এক বছর পরে সেই বিভীষিকাময় ঘটনা স্মরণ করতে গিয়ে বেকারির অন্যতম মালিক সাদাত মেহেদী বলছিলেন, ‘আমরা কখনো কল্পনাও করিনি যে এমন কিছু হতে পারে। ঝড়ের মতো ঘটেছিল সবকিছু। সেসব আর মনে করতে চাই না।’
গুলশান ২-এর ৭৯ নম্বর সড়ক ধরে সোজা পূর্ব দিকে গেলে শেষ মাথায় গুলশান লেকের পাড়ে ৫ নম্বর প্লট। এখানে ২০১৪ সালের জুন মাসে গড়ে তোলা হয়েছিল ‘হোলি আর্টিজান বেকারি’ এবং ‘ও কিচেন রেস্তোরাঁ’। ভবনটির ওপরের তলায় ছিল বেকারির রান্নাঘর এবং মালামাল রাখার ঘর। আর নিচতলায় বেকারির বিক্রয়কেন্দ্র, রেস্তোরাঁর রান্নাঘর এবং রেস্তোরাঁর অতিথিদের বসার জায়গা। সামনে সবুজ লন। অতিথিদের সংখ্যা বেশি হলে দোতলায়ও বসার ব্যবস্থা করা হতো।
লেকপাড়ের সবুজ লনযুক্ত এই বেকারি ছিল বিদেশিদের কাছে খুবই প্রিয়। খোলা থাকত সপ্তাহের সাত দিনই। শুক্র ও শনিবার সকাল ৮টায় খুলত আর বন্ধ হতো রাত ১০টায়। ওই দুই দিন এখানে সকালের নাশতার ব্যবস্থা থাকত। বাকি পাঁচ দিন খোলা থাকত সকাল ১০টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত।
রেস্তোরাঁর সহকারী শেফ শিশির বৈরাগী গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, এখানে যাঁরা খেতে আসতেন তাঁদের ৮০ শতাংশই বিদেশি। বেকারিতে ইতালিয়ান বিভিন্ন ধরনের কেক ও রুটিজাতীয় খাবার আর রেস্তোরাঁয় মূলত স্প্যানিশ খাবার বানানো হতো। অন্তত ৫০-৬০ জন অতিথি থাকতেন নিয়মিত। তবে ওই দিন রোজার শেষ দিকে ছিল বলে অতিথির সংখ্যা কমে এসেছিল। বুকিং ছিল ২৪-২৫ জনের। আগের দিন এই সংখ্যা ছিল দ্বিগুণের বেশি।
অতিথিদের প্রিয় খাবারের তালিকায় ছিল স্যামন মাছ, কোরাল মাছ, স্প্যানিশ খাবার পায়লা, কালামার ও গামবাস। চিকেন ফ্রাই, ফ্রেঞ্চ ফ্রাই, বার্গার, পিৎজাও খেতেন অনেকে। ১০-১৫ ধরনের সালাদ ছিল, যা অতিথিরা খেতেন খুব আগ্রহভরে।
শিশির বৈরাগী বলেন, শুক্র ও শনিবার সকাল থেকেই বিদেশি অতিথিরা আসা শুরু করতেন। অনেকে বাসা থেকে কাপড় বা ম্যাট্রেসজাতীয় কিছু নিয়ে আসতেন। সকালের নাশতার পর লনে তা বিছিয়ে শুয়ে থাকতেন। তাঁরা দুপুরের খাবার খেতেন। এরপর একেবারে রাতের খাবার খেয়ে বাড়ি ফিরতেন।
মনোরম এই রেস্তোরাঁতেই গত বছরের ১ জুলাই রাতে সশস্ত্র হামলা চালায় পাঁচ জঙ্গি। তখন ছিল রমজান মাসের শেষ পর্যায়। হোলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলার খবর ছড়িয়ে পড়লে রাজধানীসহ সারা দেশে গভীর উদ্বেগের সৃষ্টি হয়। জঙ্গিরা নয়জন ইতালিয়ান, সাতজন জাপানি, একজন ভারতীয় নাগরিক এবং বাংলাদেশের ফারাজ আইয়াজ হোসেন, অবিন্তা কবীর, ইশরাত আখন্দ এবং দুজন পুলিশ কর্মকর্তাসহ মোট ২২ জনকে নির্মমভাবে হত্যা করে। শেষ পর্যন্ত কী ঘটবে, এই উৎকণ্ঠার ভেতর দিয়ে রাত কাটে। পরদিন সকাল ৭টা ৪০ মিনিটে সেখানে যৌথ বাহিনী অভিযান চালায়। সাঁজোয়া যানের ধাক্কা এবং অবিরাম গুলিতে তছনছ হয়ে যায় ভবনটি। অভিযানে নিহত হয় পাঁচ জঙ্গি। অবসান ঘটে প্রায় ১১ ঘণ্টার শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতির।
জঙ্গি হামলার পর প্রায় সাড়ে চার মাস আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তত্ত্বাবধানে থাকে হোলি আর্টিজান প্রাঙ্গণ। গত বছরের ১৩ নভেম্বর পুলিশ মালিককে এর দায়িত্ব বুঝিয়ে দেয়। তবে মালিকপক্ষ জানায়, ভবনটিতে তারা কোনো বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান করবে না। দোতলা ওই ভবন নিজেদের বাসস্থান হিসেবে গড়ে তুলবে তারা। সে জন্য এখন চলছে মেরামতের কাজ।
সম্প্রতি সেখানে গিয়ে দেখা যায়, হোলি আর্টিজানের সেই ভবন যাতে সহজে চোখে না পড়ে, সে জন্য এর সামনে সবুজ রঙের টিনের বেড়া দেওয়া হয়েছে। সেখানে ঢোকার গেট বন্ধ। নিরাপত্তারক্ষী হোসেন বলেন, মেরামতের কাজ চলছে। কারও ঢোকার অনুমতি নাই। ছবিও তোলা যাবে না বলে তিনি জানিয়ে দিলেন।
আগের জায়গায় কোনো বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান না করলেও এ বছরের ১০ জানুয়ারি থেকে গুলশান নর্থ অ্যাভিনিউতে হোলি আর্টিজান বেকারির একটি শাখা চালু করেছে মালিকপক্ষ। র্যাংগস আর্কেডের দোতলায়, সুপারশপ গরমেট বাজারের একটি অংশে ৫০০ বর্গফুটের মতো জায়গায় বেকারির কার্যক্রম চলছে। প্রায় ২০ জনের বসার ব্যবস্থা আছে সেখানে। এরই মধ্যে বেকারিটি বেশ জমে উঠেছে। পুরোনো ক্রেতাদের অনেকেই এখানে কেনাকাটা করতে আসছেন।
গত ২১ জুন সেখানে গেলে কথা হয় মালিকদের একজন সাদাত মেহেদীর সঙ্গে। সাদাত বলেন, ‘ঘটনার পর হোলি আর্টিজানের কর্মচারীরা খুব অসহায় হয়ে পড়েছিল। তারা কোনো কাজ পাচ্ছিল না। মূলত তাদের কথা চিন্তা করে এই বেকারিটি খোলা হয়েছে। এখানে যারা কাজ করছে, তারা সবাই হোলি আর্টিজানের কর্মচারী ছিল।’ তিনি বলেন, হোলি আর্টিজানের ভবনটির মেরামতের কাজ প্রায় শেষের দিকে। কয়েকটি দরজা-জানালা মেরামতের কাজ বাকি আছে। ইতিমধ্যে তাঁরা নিজেদের জিনিসপত্র সেখানে স্থানান্তর শুরু করেছেন।