‘মুই কহনো সাহায্যের লাইগ্যা কারও কাছে হাত পাতি নাই। ভ্যান চালাইয়া আয়–রোজগার কইরা ভালোই চলতেছিল মোর সংসার। রাস্তাঘাট ভাঙনে হেই আয়ের পথটাও বন্ধ হইয়া গেছে। জীবনে এই প্রথম ত্রাণের লাইগ্যা লাইনে দাঁড়াইলাম। তয় আপনেগো ত্রাণে মোরা উপকার হইছে।’
প্রথম আলো ট্রাস্টের উদ্যোগে দেওয়া খাদ্যসহায়তা পেয়ে এ কথাগুলো বলেন পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার চান্দুপাড়া গ্রামের বাসিন্দা আবু সালেহ মৃধা। ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের কারণে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসে ক্ষতিগ্রস্ত সালেহ মৃধার মতো ২০০টি পরিবার পেয়েছে এই সহয়তা।
লালুয়া ইউনিয়নের মুক্তিযোদ্ধা বাজার প্রাঙ্গণে আজ মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ৯টার সময় খাদ্যসহায়তার প্যাকেট বিতরণ করা হয়। ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের হাতে একে একে খাদ্যের প্যাকেট তুলে দেন বন্ধুসভার সদস্যরা। এর আগে গতকাল সোমবার বাড়ি বাড়ি গিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত ২০০ পরিবারের তালিকা প্রস্তুত করেন বন্ধুসভার সদস্যরা। প্রতিটি পরিবারকে পাঁচ কেজি চাল, এক কেজি ডাল, দুই কেজি আলু, এক লিটার ভোজ্যতেল, পাঁচটি খাবার স্যালাইন ও একটি মাস্ক দেওয়া হয়েছে। অভাবগ্রস্ত পরিবারগুলোর সদস্যরা এসব সহায়তা পেয়ে দারুণ খুশি।
খাদ্য বিতরণের সময় বক্তব্য দেন দক্ষিণ বাংলা ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশনের (ডিবিডিএফ) চেয়ারপারসন ও শিক্ষাবিদ শহীদুল ইসলাম বিশ্বাস, লালুয়া ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মো. শওকত হোসেন বিশ্বাস, সাবেক ইউপি সদস্য তারিক খান, প্রথম আলো কলাপাড়া বন্ধুসভার সভাপতি জাহানারা খান প্রমুখ।
এ সময় অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন কলাপাড়া বন্ধুসভার সাধারণ সম্পাদক মো. রফিকুল ইসলাম, সহ–সাধারণ সম্পাদক কাজী তরিকুল ইসলাম সুনান, উপসাংগঠনিক সম্পাদক আফসানা পলি, মানবসম্পদবিষয়ক সম্পাদক মরিয়ম আক্তার, পাঠচক্র সম্পাদক প্রমিতা কর মুমু, সমাজকল্যাণ সম্পাদক জাকিয়া সুলতানা, প্রচার সম্পাদক মাহমুদুল হাসান স্বাধীন, সদস্য সিফাত আহসান, উপদেষ্টা মোস্তফা জামান এবং প্রথম আলোর কলাপাড়া প্রতিনিধি নেছারউদ্দিন আহমেদ।
কলাপাড়া উপজেলার লালুয়া ইউনিয়নটি সাগর মোহনার রাবনাবাদ চ্যানেলের পাড়ে অবস্থিত। ইউনিয়নের চাড়িপাড়া থেকে বুড়োজালিয়া পর্যন্ত প্রায় সাড়ে সাত কিলোমিটার বাঁধ আগে থেকেই বিধ্বস্ত হয়ে রয়েছে। যার কারণে স্বাভাবিক জোয়ারেও প্লাবিত হয় ইউনিয়নের অধিকাংশ গ্রাম। আর ঝড়-জলোচ্ছ্বাস হলে মুহূর্তেই প্লাবিত হয়ে পড়ে পুরো ইউনিয়ন। এবারও ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের কারণে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসে লালুয়া ইউনিয়নের চান্দুপাড়া, বুড়োজালিয়া, মুন্সিপাড়া, মঞ্জুপাড়া, নাওয়াপাড়া, চাড়িপাড়া, বানাতিপাড়া, পশুরবুনিয়া, হাসনাপাড়া, ছোট পাঁচ নং, বড় পাঁচ নং গ্রামসহ অন্তত ১১টি গ্রাম প্লাবিত হয়।
সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে চান্দুপাড়া গ্রামের বাসিন্দারা। গ্রামবাসীর ঘরবাড়ি ভেঙে গেছে। অনেকের ঘের, পুকুরের মাছ জোয়ারের পানির সঙ্গে বের হয়ে গেছে। গ্রামের বাসিন্দারা জানান, কাজকর্ম না থাকায় ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের পর থেকে কষ্টে দিন পার করতে হচ্ছে তাঁদের। অনেকের পরিবারে খাদ্যসংকট দেখা দিয়েছে। এসব গ্রামের মানুষজনের বাড়িঘর, গ্রামীণ মেঠোপথ, চাষযোগ্য কৃষিজমি এখনো জোয়ারের পানিতে তলিয়ে রয়েছে।
চান্দুপাড়া গ্রামের বাসিন্দা শাহিদা বেগমের (৫৫) সংসারে অসুস্থ স্বামী, দুই মেয়ে ও এক ছেলে। খাদ্যসহায়তা নিতে এসে তিনি বলেন, ‘মোগো ঘরদুয়ার জোয়ারের পানিতে ভাঙছে। অ্যাহন মোগো থাহনেরও কষ্ট, খাওনেরও কষ্ট। আমনেরা চাউল-ডাইল দেওনে অন্তত দুই দিন খাইতে পারমু।’
লালুয়া ইউপি চেয়ারম্যান শওকত হোসেন বিশ্বাস বলেন, আসলে ত্রাণের চেয়েও জরুরি গ্রামের মানুষের জানমাল রক্ষায় বাঁধ নির্মাণ। অথচ তা নিয়ে সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কারও কোনো চিন্তা আছে বলে মনে হয় না। বাঁধ না থাকায় এখনো ইউনিয়নের অধিকাংশ গ্রাম লবণপানিতে তলিয়ে আছে। এবার পরিস্থিতি এতটাই খারাপ, মানুষজন জমিজমা চাষ করতেও পারবেন না।