‘জীবন কেড়ে নিল ভালোবাসার মানুষটি’
ছয় মাস আগে পরিবারকে না জানিয়ে বিয়ে করেছিলেন আরিফা খাতুন ও রুবেল হোসেন। কিন্তু বিয়েটি মেনে নিতে পারছিলেন না ছেলের মা। ছেলের বউকে যৌতুকের জন্য চাপ দিচ্ছিলেন। ক্রমেই তিক্ত হয়ে উঠেছিল আরিফা-রুবেলের সম্পর্ক। শেষ পর্যন্ত ভালোবেসে বিয়ে করা স্বামীই জুসের সঙ্গে কীটনাশক পান করিয়ে স্ত্রীকে হত্যা করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
পাবনার আটঘরিয়া উপজেলার চাঁদভা ইউনিয়নের ভবানীপুর গ্রামে ঘটনাটি ঘটেছে। গত ২৫ আগস্ট রাতে আরিফাকে জুসের সঙ্গে কীটনাশক পান করানো হয়। আজ মঙ্গলবার সকালে বাবার বাড়িতে মারা যায় আরিফা।
মেয়ের মৃত্যুর পর বিকেলে মা হাসিনা খাতুন বাদী হয়ে চাটমোহর থানায় হত্যা মামলা করেন। মামলায় জামাতা রুবেল হোসেনকে একমাত্র আসামি করা হয়েছে। পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করেছে। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তিনি কীটনাশক পান করিয়ে স্ত্রীকে হত্যার কথা স্বীকার করেছেন। রুবেল একজন দিনমজুর।
স্থানীয় লোকজন ও আরিফার স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নিহত আরিফা খাতুন (১৭) চাটমোহর উপজেলার মুলগ্রাম ইউনিয়নের জগতলা গ্রামের মৃত আবদুল জলিলের মেয়ে। বাবার অবর্তমানে মা হাসিনা খাতুন একাই মেয়েকে বড় করেছেন।
বছরখানেক আগে একই গ্রামের রুবেল হোসেনের (১৮) সঙ্গে তার ভালোবাসার সম্পর্ক গড়ে ওঠে। রুবেলের বাবা অন্য গ্রামে থাকেন। গত মার্চ মাসে পরিবারের অজান্তেই বিয়ে করেন দুজন। মেয়ের সুখের কথা ভেবে হাসিনা বিয়েটা মেনে নেন। কিন্তু বেঁকে বসেন রুবেলের মা। এর মধ্যেই রুবেল স্ত্রীকে নিজ ঘরে তোলেন। শুরু হয় নানা বিবাদ। যৌতুকের জন্য আরিফাকে চাপ দিতে থাকেন শাশুড়ি। কিন্তু নিজের ইচ্ছায় ভালোবেসে বিয়ে করায় মাকে যৌতুকের কথা জানায়নি আরিফা। এ পর্যায়ে তার ওপর অত্যাচার শুরু হয়।
মামলার বরাত দিয়ে পুলিশ জানায়, যৌতুক না পেয়েই রুবেল ও তাঁর পরিবারের লোকজন আরিফার ওপর অত্যাচার চালাচ্ছিলেন। একপর্যায়ে গত ২৫ আগস্ট রাতে রুবেল জুসের সঙ্গে কীটনাশক মিশিয়ে আরিফাকে পান করান। এতে আরিফা অসুস্থ হয়ে পড়ে। বিষয়টি জানার পর হাসিনা খাতুন মেয়েকে পাবনা জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখান থেকে বাড়িতে নিয়ে আসেন। সেখানে টানা কয়েক দিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে আজ সকালে আরিফা মারা যায়।
হাসিনা খাতুন কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘মাইয়ার সুখের জন্যি সব মানে নিছিলেম। মাইয়ার জীবনের জন্যি যৌতুক লাগলিও দিতেম। কয়টা টেকার জন্যি উরা আমার মাইয়াক মারা ফেলাল। আমি ইয়ের বিচের চাই।’
চাটমোহর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আমিনুল ইসলাম জানান, কীটনাশক পান করানোর পর ছেলেটির পরিবার বিষয়টি গোপন রাখতে মেয়ের পরিবারকে চাপ দিয়েছিল। ফলে গোপনেই মেয়েটির চিকিৎসা হয়েছে। কেউ কিছু জানতে পারেননি। মেয়েটি মারা যাওয়ার পর বিষয়টি জানাজানি হয়েছে। লাশের ময়নাতদন্তের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
ওসি আমিনুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, মামলার পরই আরিফার স্বামী রুবেল হোসেনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তিনি কীটনাশক পান করিয়ে স্ত্রীকে হত্যার কথা স্বীকার করেছেন। আগামীকাল বুধবার তাঁকে আদালতে হাজির করা হবে।
পুলিশ জানায়, গত ২৬ আগস্ট পাবনা জেনারেল হাসপাতাল থেকে আরিফাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য রাজশাহী মেডিকেলে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিয়ে ছাড়পত্র দেওয়া হয়। ছাড়পত্রে লেখা রয়েছে, মেয়েটি বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত। মেয়েটির পরিবার তাকে সেখানে না নিয়ে বাড়িতে নিয়ে যায়।
মুলগ্রাম ইউনিয়নের চেয়ারম্যান রাশীদুল ইসলাম বলেন, আরিফা ও রুবেলের বিয়েটা বাল্যবিবাহ। গোপনে তাঁরা অন্য কোথাও গিয়ে বিয়ে করেছেন। আরিফা বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার পর তাঁরা বিষয়টি জানতে পারেন। শোনা কথার বরাত দিয়ে চেয়ারম্যান বলেন, রুবেলের মা জুসের সঙ্গে কীটনাশক মিশিয়ে দিয়েছেন এবং রুবেল তা আরিফাকে খাইয়েছেন বলে শুনেছেন। আরও শুনেছেন, মৃত্যুর আগপর্যন্ত রুবেল আরিফার সঙ্গেই ছিলেন। তাঁরা এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে পুলিশকে জানিয়েছেন।