জাফর ইকবালের ওপর হামলার ঘটনা ‘ধর্মীয় সন্ত্রাস’, আদালতের পর্যবেক্ষণ
স্বাধীন মত প্রকাশ ও পরমতসহিষ্ণুতা গণতন্ত্র, প্রগতিশীলতা তথা সভ্যতার অগ্রগতির প্রধান নির্ণায়ক। এগুলোর চর্চা নিশ্চিত করা না গেলে দেশ নিশ্চিতভাবেই পেছনের দিকে হাঁটবে। স্বাধীন ও গঠনমূলক ভিন্নমত চর্চার মাধ্যমেই সঠিক পথ পাওয়া সম্ভব। সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ও জনপ্রিয় লেখক মুহম্মদ জাফর ইকবালকে হত্যাচেষ্টা মামলার রায় ঘোষণার সময় আদালত পর্যবেক্ষণে এসব কথা বলেছেন।
আজ মঙ্গলবার দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে সিলেটের সন্ত্রাসবিরোধী ট্রাইব্যুনালের বিচারক মুহাম্মদ নূরুল আমীন বিপ্লব এই রায় ঘোষণা করেন। রায়ে এক আসামিকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়ার পাশাপাশি ২০ হাজার টাকা জরিমানা করেছেন আদালত। কারাদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি হলেন সুনামগঞ্জের দিরাইয়ের কালিয়ারকাপন গ্রামের ফয়জুল হাসান।
আদালত পর্যবেক্ষণে বলেছেন, মুহম্মদ জাফর ইকবালের ওপর হামলা চালিয়ে যেসব লেখক মুক্তবুদ্ধি ও প্রগতিশীলতার পক্ষে থাকেন, তাঁদের ভয় দেখানোই ছিল আসামি ফয়জুলের মূল উদ্দেশ্য। মুহম্মদ জাফর ইকবাল একজন প্রথিতযশা শিক্ষক। শিক্ষকতার বাইরে তিনি একজন শিশুসাহিত্যিক ও জনপ্রিয় লেখক। তিনি বিজ্ঞান বিষয়ে ও শিশুদের উপযোগী বই লিখে জাতির মননশীলতা গঠনে ভূমিকা পালন করে চলেছেন। ধর্মীয় গোঁড়ামি ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও প্রগতিশীলতার পক্ষে তাঁর সরব অবস্থান সর্বজনবিদিত। তাঁর ওপর হামলার ঘটনাটিকে ‘ধর্মীয় সন্ত্রাস’ উল্লেখ করে আদালত বলেন, ইসলাম ধর্মের প্রকৃত মর্মবাণীকে না বুঝে নিরপরাধ ব্যক্তিকে হত্যা করা পুণ্যের কাজ মনে করে আসামি এই বর্বর হামলা চালিয়েছেন।
আসামি ফয়জুল হাসান সম্পর্কে আদালত পর্যবেক্ষণে বলেছেন, এই আসামি দেশ বা কোনো আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী সংগঠনের সদস্য—এমনটা প্রমাণিত হয়নি। কিন্তু তিনি বিভিন্ন ইন্টারনেট সাইট থেকে জিহাদি প্রবন্ধ ও বই ডাউনলোড করে পড়ে, উগ্রবাদী বক্তাদের বক্তব্য শুনে সন্ত্রাসী কাজে উদ্বুদ্ধ হন। কিছু স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী কৌশলে ভার্চ্যুয়াল জগতে উগ্রবাদী মতবাদ ছড়িয়ে সহজে বেহেশতে যাওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে তরুণ প্রাণে সন্ত্রাসবাদের বীজ বপন করছে। উচ্চশিক্ষিত ও প্রযুক্তিতে দক্ষ তরুণেরা সহজেই তাদের পাতানো ফাঁদে পা দিচ্ছেন। আদালত উগ্রবাদী কর্মকাণ্ডে মদদ দেয়, এমন বিভিন্ন ওয়েবসাইট ও গোষ্ঠীকে চিহ্নিত করে তাদের প্রচারিত তথ্যের প্রবাহ বন্ধ করতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে বলেন।
এই মামলায় ফয়জুলের বন্ধু সুনামগঞ্জের দিরাইয়ের উমেদনগর গ্রামের মো. সোহাগ মিয়াকে চার বছরের কারাদণ্ডের পাশাপাশি পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। এ ছাড়া বাকি চার আসামি ফয়জুলের বাবা আতিকুর রহমান, মা মিনারা বেগম, মামা ফয়জুল হক ও ভাই এনামুল হাসানকে খালাস দেওয়া হয়েছে।
সন্ত্রাসবিরোধী ট্রাইব্যুনালের বিশেষ সরকারি কৌঁসুলি মুমিনুর রহমান এক আসামির যাবজ্জীবন, একজনের চার বছরের কারাদণ্ড ও চারজনের খালাস পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
২০১৮ সালের ৩ মার্চ বিকেলে শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্তমঞ্চে একটি অনুষ্ঠান চলাকালে মুহম্মদ জাফর ইকবালের ওপর ছুরি দিয়ে হামলা চালানো হয়। ওই সময় মুহম্মদ জাফর ইকবাল মাথা ও ঘাড়ে আঘাত পান। হামলার ঘটনায় শিক্ষার্থী ও পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে ফয়জুল হাসানকে আটক করে। এ ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার ইশফাকুল হোসেন বাদী হয়ে সিলেট মহানগরের জালালাবাদ থানায় মামলা করেন। এ মামলায় ফয়জুলকে প্রধান আসামি করা হয়। পাশাপাশি ফয়জুলের বন্ধু মো. সোহাগ মিয়া, বাবা মাওলানা আতিকুর রহমান, মা মিনারা বেগম, মামা ফয়জুল হক ও ভাই এনামুল হাসানকে আসামি করা হয়।
আদালতের রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন মামলার বাদী মুহাম্মদ ইশফাকুল হোসেন। তিনি বলেন, ‘আমরা এখনো পূর্ণাঙ্গ রায় হাতে পাইনি। পূর্ণাঙ্গ রায় হাতে পাওয়ার পর আপিল করা হবে কি না, বিষয়টি আইনজীবীদের সঙ্গে কথা বলে সিদ্ধান্ত নেব।’ রায়ের পর মুহম্মদ জাফর ইকবালের সঙ্গে কথা হয়েছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ ব্যাপারে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ হয়নি, কথা হয়নি।
আসামিপক্ষের আইনজীবী মোতাহির আলী বলেন, পুরো রায় না পাওয়া পর্যন্ত মন্তব্য করা যাচ্ছে না। তবে সাজাপ্রাপ্ত দুজন আসামি ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হয়েছেন বলে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। তাঁরা উচ্চ আদালতে আপিল করবেন বলে জানিয়েছেন।